Main Menu

Tuesday, February 25, 2020

Thursday, February 20, 2020

Saturday, February 15, 2020

অন্যরকম রুপা

রুপাকে নিয়ে অনেক গল্প হয়, অনেক কথা, কিন্তু কেউ তাকে প্রকাশ্যে কিছু বলে না। যেন কী এক গোপন শলাপরামর্শের মতো—কেবলই ফিসফাস, কেবলই কানাকানি, এবং হয়তো হাসাহাসিও। কেউ নিষিদ্ধ আনন্দ পায়, কেউ হয়তো আগুনে পোড়ে, কারও-কারও চোখের কোণে জলও জমা হয় তার কথা ভাবতে গিয়ে। কানাকানি যেহেতু হয়, তাই এক-কান, দু-কান করে কথাগুলো ভেঙেচুরে একসময় রূপার কানেও পৌঁছে যায়, আর তাকে বিমর্ষতায় পেয়ে বসে। কিচ্ছু ভালো লাগে না তখন, কিচ্ছু না। নিজের ভেতরে গুঁটিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকে সে আপনমনে; এমনকি প্রেমিকের আবেগময় কথাগুলোও অসহ্য রকমের বিরক্তিকর বলে মনে হতে থাকে তখন।
আমি কানাকানি-ফিসফিসানির মানুষ নই, রূপার গল্প তাই প্রকাশ্যেই বলব। তবে, আগেই জানিয়ে রাখি—এটা তার সমগ্র জীবনের গল্প নয়, কেবলমাত্র প্রেমের গল্প। মানুষের জীবনে তো গল্পের অন্ত নেই, সংকট ও সম্ভাবনারও শেষ নেই। সবকিছু নিয়ে লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। আমি তাই একটি নির্দিষ্ট দিকে চোখ ফিরিয়েছি এবং শুধুমাত্র তার প্রেমময় মনটিকেই বুঝতে চেয়েছি। এ-ও বলে রাখি, গল্পের প্রয়োজনে হয়তো এমন অনেক কথাই আমাকে বলতে হবে, যেগুলো শুনে মেয়েটি কষ্ট পেতে পারে। কারণ সে নিজের মুখোমুখি হতে ভয় পায়, আয়নার সামনে দাঁড়াতে তার দারুণ অনীহা। এই গল্প হয়তো তাকে আয়নার সামনে নিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে, কষ্ট পাবে সে, হয়তো বিব্রতও হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়তো রাগ করবে না আমার ওপর। কারণ সে জানে—তার জন্য আমার মনটা মমতায় আর্দ্র হয়ে আছে। তাকে যে আমি ভালোবাসি, সেটিও আর অজানা নয় তার। অবশ্য গল্পটা এ-যুগের, আর আমি বিগতকালের মানুষ, লেখক হিসেবেও তাই। যে বিষয়গুলো এ যুগের সম্পর্কগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে সম্বন্ধে আমার খুব বেশি ধারণা নেই। অথচ রূপার গল্প বলতে হলে ওগুলো নিয়েই কথা বলতে হবে। কতটুকু ভালোভাবে বলতে পারব, জানি না। তবে আন্তরিকতার অভাব তাতে থাকবে না—এটুকু বলা যায়। প্রয়োজনে রূপার সঙ্গে কথা বলে না-বোঝা বিষয়গুলো বুঝে নেব। কিছু কথা হয়তো আপনাদেরকেও জানাব।
যেখান থেকে এই গল্প শুরু করেছিলাম, সেখানেই ফিরে আসি আবার। এত যে কথা হয় তাকে নিয়ে, তার কারণ কী? কারণ আছে, যথার্থ কারণ। তার জীবন ছিল উদ্দামতায় ভরা। হাসি-আনন্দ-উচ্ছলতা; আড্ডা-আড্ডা-আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো, রঙ্গরস, কারও জন্য বিশুদ্ধ ভালো লাগা, কারও জন্য ভালোবাসা, কারও জন্য মন পুড়ে যাওয়ার অনুভূতি, আর, একজনের জন্য প্রেম। কীভাবে যেন একটা বন্ধু-বৃত্ত গড়ে উঠেছিল তাদের। সচরাচর এভাবে এরকম গভীর বন্ধুতা গড়ে উঠতে দেখা যায় না—অন্তত আমি কখনো এমনটি দেখিনি। মানে, সাধারণত যেভাবে গড়ে ওঠে—স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সঙ্গে, কখনো সহকর্মীদের সঙ্গে, কখনো পেশাগত প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে দু-চার জন মানুষকে পছন্দ হয়ে যাবার সূত্রে—তাদের বন্ধুত্বটা ঠিক সেভাবে হয়নি। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পেশার এই মানুষগুলো পরস্পরের সঙ্গে কেবলমাত্র ভার্চুয়ালিই যুক্ত ছিল; অপরিচিত হয়েও পরিচিত, দূরের হয়েও কাছের—এই রকম। ভার্চুয়াল শব্দটির জুতসই বাংলা প্রতিশব্দ পাচ্ছি না বলে হয়তো ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না। বলতে চাইছি, তাদের যোগাযোগের প্রথম মাধ্যম ছিল চ্যাটরুম এবং তারপর ফেসবুক। এগুলো এমন ধরনের যোগাযোগ-মাধ্যম যে, সারা জীবনে দেখা না হলেও ‘বন্ধু’ হয়ে ওঠা যায়। জানি, আমার মতো আপনারা অনেকেই এই বিষয়টির সঙ্গে তেমন পরিচিত নন, কিন্তু এ যুগের গল্প শুনতে চাইলে এগুলো বুঝে নিতে হবে, কিচ্ছু করার নেই। এরকম বন্ধুত্ব আমরা—মানে সেকেলে মানুষেরা—কল্পনাও করতে পারি না। আমাদের সময়ে সশরীরে দেখা হওয়া ছাড়া বন্ধুত্ব হওয়াটা অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। দেখা হলেও যে সব সময় বন্ধুত্ব হতো, তা-ও নয়। পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া-পাওয়া, মতাদর্শিক ঐক্য—ইত্যাদি একেকটা বিষয় হিসেবে কাজ করত। অবশ্য বিনা কারণেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার নজির বহু আছে। সেটা প্রধানত সহপাঠী বা পাড়া-মহল্লার সমবয়সীদের সঙ্গে। আর বন্ধুত্ব হবার পর দেখা যেত, একে অন্যের পছন্দ-অপছন্দ-রুচি-আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তবে এসব ক্ষেত্রে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা অনিবার্য ছিল। অবশ্য পত্রমিতালি বলে একটা ব্যাপারও ছিল তখন। বিচিত্রার ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বিভাগে বা চিত্রবাংলা, ছায়াছন্দ, পূর্বাণী, চিত্রালী—এই ধরনের সিনে ম্যাগাজিনের পত্রমিতালিতে ইচ্ছুকদের নাম-ঠিকানা-বয়স-শখ ইত্যাদি ছাপা হতো। সেখান থেকে একেক জন বেছে নিত এক বা একাধিক পত্রমিতাকে, তারপর চলত চিঠি চালাচালি। সম্পর্ক খুব বেশি দূর এগোত না, বলাই বাহুল্য। তখন মোবাইল ফোনের বালাই ছিল না, কথা হওয়াও তাই প্রায় অসম্ভব ছিল। শহরাঞ্চলের কোনো কোনো বাসায় টিঅ্যান্ডটির ফোন লাইন থাকত বটে, কিন্তু সেটাও বেশ বিরল ঘটনা ছিল। তখন ল্যান্ডফোন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক, আর সংযোগ পাওয়া ছিল প্রায় সোনার পাথরবাটির মতোই সুদূর ব্যাপার। আবেদন করে বছরের পর বছর বসে থাকতে হতো। ওপর মহলে ধরাধরি না করতে পারলে একটা ফোন নম্বর জোগাড় করা ছিল দারুণ কষ্টকর ব্যাপার। যাহোক, দেখা হওয়া ছাড়া চিঠিই যেহেতু ছিল একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম, আর ডাকবিভাগের কচ্ছপ-গতি চিঠিগুলোকে আনা-নেওয়া করতে যেহেতু দীর্ঘ সময় নিত, ভুলেই যেতে হতো, কী লেখা হয়েছিল আর কী উত্তর পাওয়া গেল! খুব ব্যতিক্রম ছাড়া দেখাও হতো না। অনিবার্য পরিণতি হিসেবে মিতালির অবসান ঘটত। এত ধীরগতির যোগাযোগব্যবস্থায় বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। এখনকার ব্যাপারটা ঠিক উল্টো, যোগাযোগ-মাধ্যমটা অতি দ্রুতগতির। মুহূর্তের মধ্যেই অনুভূতিটা জানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে পরস্পরকে। আমার ধারণা, এত দ্রুতগতির যোগাযোগেও সম্পর্ক ঠিক দানা বেঁধে উঠতে পারে না। যাহোক, আমি বসেছি রূপার গল্প শোনাতে, ‘যোগাযোগমাধ্যম এবং বন্ধুত্ব’-শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করতে নয়। তো, রূপাদের বন্ধুত্বের শুরুটা ভার্চুয়াল মিডিয়া-নির্ভর হলেও ক্রমে সেটা বাস্তব যোগাযোগে মোড় নেয় নিজেদের ফোন নম্বর বিনিময়ের মাধ্যমে। সবাই অনুভব করতে পারছিল, পরস্পরের সঙ্গে যেন আত্মার বন্ধনে বাঁধা পড়েছে তারা। নইলে না দেখা মানুষগুলোর জন্য এত খারাপ লাগে কেন? কেন সারা দিন ভার্চুয়াল আড্ডায়ও মন ভরে না, রাতও গভীর হয় তাদের সঙ্গেই! কেন কারও কারও জন্য বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে? অনুভূতি যখন এত তীব্র, তখন সঙ্গ পাওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতার জন্যই হয়তো তারা আর ভার্চুয়াল জগতে থাকতে চাইল না, পরিচিত হতে চাইল পরস্পরের সঙ্গে। আর কয়েক জন মানুষ যখন একসঙ্গে একটি বিষয়ে এক আকাঙ্ক্ষায় যুক্ত হয়, তখন তা কার্যকর হতে খুব বেশি সময় লাগে না। তাদের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছিল। যেকোনো দুজন মানুষের প্রথম দেখা হওয়ার মধ্যে খানিকটা অপরিচয়ের দূরত্ব থাকে, খানিকটা দ্বিধা থাকে সংলগ্ন হওয়ায়। কিন্তু তারা সেটা টেরই পেল না। যেন কত দিনের চেনা, কত কাছের, কত আপন এই মানুষগুলো! তুমুল আড্ডায় মেতে উঠল তারা। এত দিনের ভার্চুয়াল সম্পর্কের নানা স্মৃতিচারণে আর নানা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে হেসে লুটোপুটি খেল একেক জন। এমন নির্মল আনন্দ-আড্ডায় মেতে ওঠা কেবল অতি-তরুণদের পক্ষেই সম্ভব, যারা এখনো জীবনের গভীরতর জটিলতার মুখোমুখি হয়নি। তারা কেউই তা নয়, জীবন তাদেরকে যথেষ্টই ভোগাচ্ছে নানা উপায়ে। বয়সেও কেউ টিনএজ নয়, তারুণ্য অটুট থাকলেও অভিজ্ঞতার ধুলো পড়ে সেটা খানিকটা পোড় খাওয়া চেহারা পেয়েছে। অথচ এই সব দুঃখ ও বেদনা, গ্লানি ও হতাশার কথা ভুলেই গেল তারা। বাধহীন উচ্ছলতায় ফিরিয়ে আনল সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তারুণ্যের কাল।
সেই শুরু। তারপর থেকে কী না করেছে তারা? কী কী করেছে, সেসবের বিবরণ না হয় একটু পরেই দিই। আপাতত এটুকু বলা যাক, এসব কিছুর মধ্যমনি ছিল রূপা নামক এক প্রাণবন্ত-উদার-উচ্ছল তরুণী। বিয়ে-সংসার-সন্তানের অভিজ্ঞতা হলেও সে সবের ছাপ পড়েনি তার আচরণ ও উদ্দামতায়। নজরকাড়া সুন্দরী সে এবং আকর্ষণীয় এবং আবেদনময়ীও। এবং নিয়মিত আড্ডা-টাড্ডা-ঘোরাফেরার আয়োজন করতে হলে কিছু অর্থনাশও হয়—সে ব্যাপারেও রূপা অকৃপণ-উদার। যেন সবাইকে আনন্দ দিয়েই তার সুখ। তাহলে এত প্রশ্ন কেন, কেন এত ফিসফিসানি আর কানাকানি রূপাকে নিয়ে? কারণ তো আছেই এবং সেটি বেশ অদ্ভুত। রূপার জীবন ভালোই চলছিল, বদ্ধ-নিঃসঙ্গ ঘরের অপূর্ণতা সে পুষিয়ে নিচ্ছিল বাইরের উন্মুক্ত পৃথিবীর উদার হাওয়ায়; আর বন্ধু ও প্রেমার্থীর আন্তরিকতা ও আদর-সোহাগে। কিন্তু এর মধ্যেই তার জীবনে এল এক বিষণ্ন যুবক। তাকে গুরুত্ব দেবার মতো কোনো কারণ ছিল না। অতি সাধারণ আটপৌরে এক যুবক সে। কিন্তু কেন যে তার সঙ্গেই প্রেমটা হয়ে গেল, কীভাবেই বা হলো, বলা মুশকিল। লীলাময় এই জগতে কে যে কখন কার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে! প্রেমটা হবার পর রূপার জীবনটা পাল্টে গেল আরেক দফা, মোড় নিল অন্য দিকে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি, ঘোরাফেরা, কথাবার্তা কমতে কমতে এক পর্যায়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এল। একদিনে ঘটেনি ব্যাপারটা, দীর্ঘ দিন ধরে ধীরে ধীরে ঘটছিল। কিন্তু যেভাবেই ঘটুক, বন্ধুরাই বা এত সহজে ছাড়বে কেন? এত এত স্মৃতি রেখে, এত এত আনন্দময় উজ্জ্বল সময় একসঙ্গে পার করে হঠাত্ কেউ সটকে পড়বে, তা কি হয়? তা ছাড়া, বন্ধুদের মধ্যে একজন প্রেমিকও তো ছিল, যে প্রেমের কথা জানাতে দ্বিধাবোধও করেনি। রূপার কিছুটা দ্বিধা থাকায় প্রেমটি গ্রহণ না করলেও সরাসরি প্রত্যাখানও করেনি। বরং সে-ও তার ভালোলাগার কথা জানতে দিয়েছে, প্রেমময় মুহূর্ত পার করেছে, কান পেতে শুনেছে প্রেমাকাঙ্ক্ষীর প্রেমময় কথামালা। সে-ই বা এত সহজে ছাড়বে কেন? ফলে, কথা চলতেই থাকল। রূপার এই হঠাত্ অন্তর্ধানে তার বন্ধুদের ভেতরকার একটা বর্ণিল-মজবুত সুতো যেন ছিঁড়ে গেছে। তারা তাই কানাকানি করে, ফিসফিসানি চলে, নিজেদের ভেতরে আলাপ করে বুঝে নিতে চায় রূপার এই অদ্ভুত পরিবর্তনের সম্ভাব্য কারণটি। ব্যক্তিগত যোগাযোগের চেষ্টাও অব্যাহত থাকে। বিশেষ করে প্রেমিকটি, যেন কিছুতেই পথ ছেড়ে দাঁড়াবে না, এমন ভঙ্গিতে নাছোড় হয়ে থাকে।
এসব কথা রূপা আমাকে বলেছিল। কিন্তু আমি বোধ হয় মাঝখানের এক বিরাট অংশ বাকি রেখেই গল্পের পরবর্তী পর্বে চলে গিয়েছি। ওটা না বললে তো গল্পটা পূর্ণতা পাবে না।
দুই
অন্যদের কথা বলবার সাধ্য আমার নেই। কারণ আমি শুধু রূপাকেই চিনি। তার গল্পই বলতে বসেছি। অন্যদের দেখেছি খানিকটা দূর থেকে, অতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া হয়নি কখনো। তাদের কথা বলতে গিয়ে আমাকে হয়তো অনেক বেশি কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। সত্যি ঘটনার ভেতরে কল্পনার এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবেশকে আশা করি আপনারা মার্জনা করবেন। আর আপনারা তো বোঝেনই, যে গল্প আপনারা পড়েন বা শোনেন, তার পেছনে একজন সর্বজ্ঞ স্রষ্টা থাকেন, যিনি গল্পের চরিত্রগুলোর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত্ জানেন। এমনকি তাদের মনের কথাও জেনে বসে থাকেন! ওসব গল্পে সেই সর্বজ্ঞ স্রষ্টা নিজেকে আড়ালে রাখেন বলে আপনারা প্রশ্ন তোলেন না যে, লেখক এত কিছু জানলেন কীভাবে? তোলার কথাও নয়। গল্প তো গল্পই। এই গল্পে আমি না হয় আড়ালে না থেকে প্রকাশ্যেই আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি, আমাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা কি উচিত হবে আপনাদের? যাহোক, গল্পে ফিরে আসি। রূপা সংসারী মেয়ে। মানে, সংসারে এখন ততটা মন না থাকলেও একটা সংসার আছে তার। স্বামী আছে, একটা টুকুটুকে খোকাবাবু আছে, একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে ভালো পদে চাকরিও আছে। এত কিছু সামলে এ রকম বিরামহীন আড্ডায় শামিল হওয়া কঠিন। কিন্তু কীভাবে যেন সব ম্যানেজ করে ফেলত রূপা! স্বামী—বাদল—ব্যস্ত মানুষ, খুব ব্যস্ত, খুবই ব্যস্ত। বড় মাপের ব্যবসায়ী তিনি, সকালে বেরিয়ে বাসায় ফেরেন গভীর রাতে। রূপা হয়তো ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বামীর জন্য রাত জেগে বসে থাকার আবেগ এত দিনে থিতু হয়ে এসেছে। তা ছাড়া, শরীরেও কুলোয় না। সারা দিন অফিস, ভার্চুয়াল আড্ডা, বাস্তব আড্ডা শেষে বাসায় ফিরে আবার ভার্চুয়াল আড্ডায় সময় কাটাতে গিয়ে ক্লান্তও হয়ে পড়ে খুব। তাদের দুজনের প্রায় দেখাই হয় না। এমনকি, ছুটির দিনেও লোকটার ব্যস্ততার অন্ত নেই, সুখ-দুঃখের কথা বলা বা শোনার সময় তো নেই-ই। রূপা তাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল এবং তখন বোঝা যায়নি—এই লোক এতটা বৈষয়িক মানুষ, সাফল্যের জন্য তার এত কাঙালপনা! রূপা ঠিক এর উল্টো স্বভাবের। এত কিছুর দরকার নেই তার। একটা জীবন চালিয়ে নেওয়ার মতো সচ্ছলতা থাকলেই হলো—এ রকমই সে ভেবে এসেছে সব সময়। বিয়ের সময় বাদল চাকরিজীবীই ছিল। তার একার আয়ে সংসার চালানো কঠিন বলে রূপাও ঢুকে পড়েছিল কাজে। দুজনই সারা দিন অফিসে ব্যস্ত। তবু, তখনকার দিনগুলো বড় মনোরম ছিল বলে মনে হয় এখন। সারা দিন কাজ শেষে দুজন টুকটুক গল্প বা রিকশায় করে হাওয়া খাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়া, শহরের নির্জন এলাকাগুলো চষে বেড়ানো, কখনো বা একটা ছোটখাটো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে শখের খাবার খাওয়া। এই তো অনেক। আর কী চাই জীবনে! শ্বশুর-শাশুড়ি-দেবর-ননদ নিয়ে চমত্কার সাজানো সংসার ছিল রূপার। কিন্তু কয়েক বছরের ভেতরে সব যেন কেমন অচেনা হয়ে গেল! বাদলের মাথায় ব্যবসার পোকা ঢুকল। দুম করে একদিন চাকরি ছেড়ে দিল, শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেলেন বছরখানেকের ব্যবধানে। তারও বছরখানেক পর ননদের বিয়ে হয়ে গেল। দু-বছর পর দেবরটা দেশের বাইরে চলে গেল। রূপার কোলে তত দিনে ফুটফুটে খোকা এসেছে। কিন্তু কথা বলার মতো সঙ্গী নেই। বাসায় ফিরে অথবা ছুটির দিনের সময়গুলো পাহাড়ের মতো মনে হতো; যদিও খোকার পেছনে অনেকটা সময় যায়, তবু ওটা আর কতক্ষণ! প্রায় সারা দিন-রাতই ঘুমায় বাচ্চাটা। রূপার তখন ভীষণ একা লাগে। কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কথা বলার বা শোনার মানুষ কই? ঠিক এ রকম একটি সময়েই তার পরিচয় ঘটল ভার্চুয়াল বন্ধুদের সঙ্গে, চ্যাটরুমে। তারপর ফেসবুক, টুইটার, স্কাইপি ইত্যাদি। ধীরে ধীরে ১৪-১৫ জনের বন্ধুবৃত্তটা গড়ে উঠল একসময়। এ রকমই হয়। জীবনে অজস্র লোকের সাথে পরিচয় হয় আমাদের। কিন্তু বন্ধুত্ব হয় বেছে বেছে কয়েক জনের সাথে! কিন্তু ওদের এই বন্ধুত্বের ধরনটা বোঝা আমার জন্য একটু কঠিন। তাই রূপাকেই জিজ্ঞেস করি—
চ্যাটরুম বা ফেসবুক থেকে বন্ধুত্ব হয় কীভাবে?
অ! আপনি তো আবার এগুলো বোঝেন না! —রূপা খোঁচা দেয়।
আসলেই বুঝি না। একটু বুঝিয়ে বলবে?
চ্যাটরুম ব্যাপারটা বোঝেন?
উঁহু, একেবারেই না।
তাহলে তো মুশকিল! চ্যাট বোঝেন?
হ্যাঁ, তা একটু বুঝি। দুজন মানুষের মধ্যে আলাপ, মানে অনলাইন আলাপ। তবে কথাবার্তা মুখে উচ্চরিত হয় না, লিখে লিখে আলাপ করতে হয়।
হ্যাঁ, তাই। চ্যাটরুমেও ব্যাপারটা ওরকমই ঘটে। বন্ধুদের একটা আড্ডার জায়গা ওটা। ওখানে আপনি কেবল একজনের সঙ্গেও আলাপ করতে পারেন, আবার দল বেঁধে আড্ডাও জমাতে পারেন।
লিখে লিখে আড্ডা দেয় কীভাবে?
কেন, সমস্যা কী?
না, মানে, আড্ডা তো বেশ গতিশীল ব্যাপার। একসাথে অনেকে কথা বলে, আলোচনা বিভিন্ন দিকে ধাবিত হয়।
এখানেও সে রকমই ঘটে।
কিন্তু লেখার ব্যাপারটা বেশ ধীরগতির না? একটা বাক্য লিখতেই তো অনেক সময় চলে যায়! সে ক্ষেত্রে আড্ডাটা কেমন স্লো আর বোরিং হয়ে যায় না?
না, তা হয় না। সবাই ছোট ছোট বাক্য লেখে। আর লেখার গতিও অনেক। যারা অভ্যস্ত, তাদের টাইপিং স্পিড তো কম হয় না!
তা ঠিক। কিন্তু এই বন্ধুত্ব কীভাবে গড়ে ওঠে? আগে বন্ধুত্ব, পরে চ্যাট; নাকি আগে, চ্যাট পরে বন্ধুত্ব?
দুটোই হতে পারে। শুরুটা হয়তো চেনাজানাদরে মধ্যেই শুরু হয়। তারপর, একজনের রেফারেন্সে আরেক জন আসে, তার সাথে অন্যদেরও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে—এ রকম।
হুম। আর ফেসবুকে বন্ধুত্বের ব্যাপারটা?
ওটাতে তো আপনি প্রথমেই কাউকে বন্ধু হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে আপনার বন্ধু তালিকায় যুক্ত করে নিচ্ছেন!
অপরিচিত মানুষকে?
পরিচিত-অপরিচিত সব ধরনের মানুষকেই।
পরিচিত মানুষের ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু অপরিচিত মানুষকে পরিচয় হবার আগেই বন্ধু হিসেবে স্বীকার করে নেয় কীভাবে?
ঠিক বন্ধু হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া নয়। বন্ধুত্বের আহ্বানকে স্বীকার করে নেওয়া—কেউ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল, আপনি সেটা অ্যাকসেপ্ট করে নিলেন। মানে বন্ধু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিল!
এভাবে বন্ধুত্ব হয়?
হয় তো! কত হচ্ছে!
এটা আমার বোঝার বাইরের ব্যাপার। যাকগে। তাহলে এভাবেই তোমাদের বন্ধুত্ব হলো?
হ্যাঁ। শুরুটা ও রকমই ছিল।
যাহোক, রূপার সঙ্গে আলাপ বাদ দিয়ে বরং গল্পটা বলি। ভার্চুয়াল জগত্ ছেড়ে তাদের বন্ধুতাটা যখন বাস্তবে রূপ নিল, তখন যেন আবেগে ভেসে যাবার মতো অবস্থা হলো সবার। আর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ওলোটপালোট হবার জোগাড় হলো। অফিসে সব কাজের পাশাপাশি কম্পিউটার স্ক্রিনে অন্তত দু-তিনটে সাইট খোলা থাকে এদের। ফেসবুক, স্কাইপি আর চ্যাটরুম। আড্ডা চলে সব জায়গাতেই। তুমুলভাবে। কাজে আর মন বসে না। ভুলভাল হয়, তবু নেশা কাটে না। সেখানেই শেষ নয়। অফিস ছুটির আগেই ওই চ্যাটে বসেই সিদ্ধান্ত হয়—বিকালে রবীন্দ্র সরোবরে (বা অন্য কোথাও) আড্ডা হবে। সবাই অফিস থেকে বেরিয়ে বাসায় যাবার বদলে আবার আড্ডায় এসে মিলিত হয়। ছুটির দিনেও এর ব্যতিক্রম ঘটে না। সকালে উঠেই ভার্চুয়াল আড্ডা, বিকেলে শহরের কোনো এক জায়গায় বাস্তব আড্ডা। সেখান থেকে ফিরে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত আবার ভার্চুয়াল আড্ডা। এসব আড্ডায় বিষয়বস্তুর কোনো মাথামুন্ডু থাকত না। এমনকি আলাপগুলো কখনো কখনো কার্টেসির সীমা ছাড়িয়ে শরীর-ছোঁয়াও হয়ে উঠত! দুষ্টুমি করে কখনো কখনো ছেলে-মেয়েতে স্পর্শও ঘটত। সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, অধিকাংশই বিবাহিত, মনের দিক থেকে সবাই খোলামেলা। ফলে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে কোনো বাঁধ দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।
রূপা ভুলেই গিয়েছিল, এই বন্ধুরা ছাড়া তার জীবনে অন্য কোনো বিষয় আছে। এমনকি খোকার দিকেও খেয়াল ছিল না তার। পুরোনো বিশ্বস্ত বুয়াটাই দেখে রাখত ওকে। কোনো কোনো ছুটির দিন তারা দল বেঁধে ঢাকার বাইরে কাছাকাছি কোথাও চলে যেত। মাওয়া-গাজীপুর-পুবাইল-মানিকগঞ্জ-সোনারগাঁও-পূর্বাচল—কত জায়গা! সারা দিন কাটত হাসি-আনন্দে, উচ্ছলতা-উদ্দামতায়। এর ভেতরেই রূপা টের পেয়ে গেল, বন্ধুদের ভেতরে অন্তত একজন তার প্রেমে পড়েছে। ধরা যাক, তার নাম নক্ষত্র। অবশ্য এ রকম নাম অবিশ্বাস্য। কিন্তু লোকটা রূপার মনে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় বিরাজ করত বলে সে আমাকে ওই নামটিই বলেছিল। আগেই তো বলেছি, এদের সবাইকে আমি ভালোভাবে চিনি না। রূপাই আমার সমস্ত তথ্যের উত্স। নামের সন্ধানে বের হওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। তবে গল্পের জন্য একটা নাম দিয়ে নেওয়াটাই সুবিধাজনক। ধরা যাক, তার নাম মামুন। আগেই বলেছি—রূপা সুন্দরী-আকর্ষণীয়-আবেদনময়ী মেয়ে। সুন্দরী হলেই সবাই আকর্ষণীয় হয় না। সুন্দরী এবং আকর্ষণীয় হলেও সবাই আবেদনময়ী হয় না। রূপার ভেতরে সবই আছে। প্রায় কৈশোর থেকেই সে তার রূপের স্তুতি শুনে আসছে। আর পুরুষদের চোখে দেখে আসছে লোভ। বন্ধুদের অনেকের চোখেও সে লোভ দেখেছে। আর ঘৃণায় কুঁকড়ে গিয়েও স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে চেয়েছে। ওই একজনের চোখে সে দেখল মুগ্ধতা, প্রেম ও কামনা। শুধু কামনা বিরক্তি বাড়ায়। কিন্তু মুগ্ধতা আর প্রেম থাকলে কামনাও কাম্য হয়ে ওঠে। এমন নয় যে, এটাই রূপার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রেম তার জীবনে বারবারই এসেছে। কিন্তু সে সাড়া দিয়েছে কম। ফলে ওসব প্রেম একতরফাই থেকে গেছে শেষ পর্যন্ত। এ-ও সত্যি যে তারও ভালো লেগেছে কাউকে কাউকে। কিন্তু অভ্যাসবশত সেটি প্রকাশ করেনি এবং সেটাকে ভালোলাগার পর্যায়েই থাকতে দিয়েছে, প্রেম পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। তবে যে দু-চারবার প্রেমে পড়েছে সে, সেগুলো ছিল অতি তীব্র আবেগে ভরা।
মামুনের প্রতি প্রেমটাও তেমনই হয়ে উঠল। শুরুতে কেবল মুগ্ধতাই ছিল ব্যাপারটি—কী স্মার্ট, ভদ্র, নম্র, সুন্দর, শিক্ষিত আর জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত একজন মানুষ! দুজনের মুগ্ধতা এক বিন্দুতে মিলে গেলে প্রেম হবারই কথা। কিন্তু হতে হতেও হলো না। রূপার প্রতি যেমন ছেলেরা আকর্ষিত হতো, তেমনি মামুনের প্রতিও অন্য মেয়েদের আকর্ষণ ছিল প্রবল। পার্থক্য হলো এই যে, রূপা অন্যদের মুগ্ধতা পাশ কাটিয়ে চলে যেত—দেখেও না দেখা, বুঝেও না বোঝার ভান করে; কিন্তু মামুন তা করত না। সে তার প্রতি মেয়েদের মুগ্ধতার ব্যাপারটা উপভোগ করত। সবাই-ই একটু-আধটু মনোযোগ পেত তার কাছ থেকে। রূপা চাইত, এককভাবে তার কাছেই সমর্পিত হোক লোকটা, ঠিক সে যেমন সমর্পিত হয়ে আছে। কিন্তু মামুন এসব কথায় কান দিত না। বলত—
আমি তো ওদের প্রেমে পড়িনি, শুধু একটু মজা করছি, এত আপত্তি করছ কেন এ নিয়ে?
আমি যদি এ রকম করি, মেনে নেবে তুমি?
মন চাইলে কর! মানব না কেন? তার আগে বল তুমি আমার কি না? এটা কনফার্ম না হয়ে কী মানব কী মানব না, সে কথা আগেই জানতে চাও কেন?
রূপার এই ব্যাপারটি মামুন ঠিক বুঝে উঠতে পারত না। এর কারণও আছে। তার জীবনেও প্রেম এসেছে বারবার এবং সর্বদাই সাড়া দিয়েছে সে। প্রেম তার কাছে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর-কাম্য-মহিমামণ্ডিত প্রাপ্তি বলে মনে হয় বলে এই সাড়া দেওয়াটাকেই সে যথার্থ বলে মনে করেছে। সে নিজেও প্রেমে পড়েছে বারবার; আর যাদের প্রেমে পড়েছে, তাদের সেটা জানাতেও দ্বিধা করেনি। এবং সাড়া পেয়েছেও সব সময়। তার জীবনে আসা কোনো প্রেমই একতরফা নয়! কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে সে সাড়া পাচ্ছে না, যদিও বুঝতে পারছে—রূপা তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কেন যে মেয়েটি অন্য মেয়েদের প্রতি তার আগ্রহ ও মনোযোগ নিয়ে এত মাথা ঘামায়! তার কি একাধিক মেয়েকে ভালো লাগতে পারে না? কিংবা রূপা কি একাধিক ছেলেকে পছন্দ করতে পারে না? সে তো লুকোয় না কিছু। মানে ভণ্ডামির অবকাশই নেই। এবং সেটিই কি রূপার কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিষয় হয়ে উঠবার কথা নয়? জগতের কোন পুরুষ একাধিক মেয়ের জন্য কাতর হয় না? কোন পুরুষ মনের দিক থেকে কেবল একজনকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে? তুমি বিবাহিতা, একজন পুরুষকে নিয়ে থাকছ আবার আমাকেও চাইছ—এটা যদি অস্বাভাবিক না হয়; কিংবা আমি বিবাহিত, একজন নারীর সঙ্গে সংসার করছি, সঙ্গম করছি—সেটা যদি গ্রহণযোগ্য মনে হয়, তাহলে আমার এই একাধিক পছন্দ কেন অস্বাভাবিক মনে হবে? অন্য সবাই যা লুকিয়ে করে অথবা মনে এক কথা পুষে রেখে মুখে বলে আরেক কথা, আমি তো সেটা করি না! ভণ্ডামি না করাটাই তাহলে দোষের? সত্যি বলতে কি, মামুন জীবনকে দেখতে চেয়েছে আনন্দ ও উপভোগের চোখ দিয়ে। সমস্ত প্রেম দু-হাত পেতে গ্রহণ করতে চেয়েছে, কাউকে ফেরাতে ইচ্ছে করেনি। করবেই বা কেন? একটাই মাত্র জীবন। এমনিতেই তা নানা শৃঙ্খলে বাঁধা, নতুন নতুন শৃঙ্খল পরিয়ে লাভ কী? নিশ্চয়ই সব প্রেম তার কাছে সমান আকর্ষণীয় নয় বা সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব বহন করে না! রূপার প্রতি তার আকর্ষণটা সবচেয়ে তীব্র, সে তো বোঝে সেটা। এমন প্রখর আবেদনময়ী শরীর যে সে দেখেনি আর কোনো দিন! অথচ রূপার কাছে এই আকর্ষণের চেয়ে বড় হয়ে উঠল অন্যদের প্রতি তার টুকিটাকি আকর্ষণগুলো! কী দুর্ভাগ্যজনক!
রূপা সব বুঝত! আর তাই, ‘আমি তো তোমারই’—এ কথা বারবার বলতে চেয়েও মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেনি সে। কী এক দ্বিধা এসে বাধা দিত তাকে! কিন্তু নানা আচরণে কি সে সেটি বুঝিয়ে দেয়নি? সে কি শুধুমাত্র মামুনকেই ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেনি? সুযোগ পেলে তার হাত ধরেনি? গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকেনি? পছন্দ করে বলে মামুনকে তার চোখ দিয়ে নিজের রূপ-যৌবন দেখবার সুযোগ করে দেয়নি? কান পেতে কি শোনেনি তার শরীরছোঁয়া দুঃসাহসী কথাবার্তা? মামুন রূপার শরীর চায়, তীব্রভাবে চায়, তার লোভ হয় রূপার শরীর পেতে—প্রেম হবার আগেই এসব কথা শুনেও কি তার কাছ থেকে দূরে সরে না গিয়ে আরও কাছে ঘেঁষে বসেনি? তার সুবিধা-অসুবিধা-প্রয়োজন-আনন্দের দিকে কি সর্বক্ষণিক তীক্ষ দৃষ্টি রাখেনি? সে খুশি হবে ভেবে কি এমন অনেক কাজ করেনি, যেগুলো মেয়েরা শুধুমাত্র প্রেমিক-স্বামীর জন্যই করতে পারে? আর কতভাবে বোঝাতে হয়? অথচ সে শুনতে চায়—যেন মুখে না বললে প্রেম হয় না! শুনতে চায়, কিন্তু শোনার শর্তগুলোও পূরণ করে না! মেয়েদের সাথে রঙঢঙ ছাড়তে চায় না। অথচ তাকে অন্য ছেলেদের সাথে একই রকম আচরণ করার অনুমোদন দেয়! এ কেমন কথা? রাগ হতো তার, অভিমানে বুক ভরে উঠত, তবু তাকে ছেড়ে যাবার কথা মনেও আনতে পারত না। যতই দিন যাচ্ছিল, ততই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল প্রেমের অনুভূতি।
এর মধ্যেই দুটো ঘটনা ঘটল। মামুনের জীবনে আবির্ভাব ঘটল আরেকটি মেয়ের। ধরা যাক তার নাম ঘষেটি বেগম, মানে রূপার ভাষায় আর কি! নাহ, গল্পের সঙ্গে নামটি যাচ্ছে না—কেমন যেন একটা ঐতিহাসিক গন্ধ আসছে! ধরা যাক, মেয়েটির নাম নীলিমা। তো, নীলিমার সঙ্গে মামুনের সম্পর্ক নিয়ে রূপার মনে অনেক দিন ধরেই একটা সন্দেহ ছিল। তাদের সম্পর্কটি যেন ঠিক বন্ধুত্ব নয় বরং এর অধিক কিছু। যদিও প্রকাশ্যেই তারা প্রচুর খুনসুঁটি করে, কোনো রাখঢাকের বালাই নেই, তবু রূপার চোখে যেন বাড়তি কিছু ধরা পড়তই। আর নীলিমাও যেন পরিষ্কার করেই বুঝিয়ে দিতে চাইত যে, মামুনের সঙ্গে তার সম্পর্কটি প্রেমের। রূপা-মামুনের সম্পর্কের ব্যাপারটাও নীলিমা বুঝে ফেলেছিল বলে হিংস্র বাক্যবাণে জর্জরিত করতে ছাড়ত না সে। ভাবছেন, একেবারে বাংলা সিনেমার কাহিনি ফেঁদে বসেছি? ত্রিভুজ প্রেম, এর মধ্যে একজন আবার ভ্যাম্পায়ার! ও-রকম ভাবলেও কিছু করার নেই। পৃথিবীতে এমন একটি প্রেমও আজ পর্যন্ত হয়নি, যেখানে তৃতীয় একটি পক্ষ এসে হাজির হয়নি, সেটি ছেলেটির পক্ষ থেকেই হোক বা মেয়েটির পক্ষ থেকেই হোক। তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি বোধ হয় প্রেম-জীবনের এক অনিবার্য নিয়তি। খামোখা বাংলা সিনেমার দোষ দিয়ে লাভ নেই। তো, রূপা-মামুনের ভেতরে নিলীমা নামক তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি নিয়ে রূপা মামুনকে কঠিনভাবে প্রশ্ন করলেও সে তার স্বভাবসুলভ মধুর হাসি আর দু-চারটে প্রেমময় বাক্য বলে তাকে শান্ত করতে সক্ষম হতো। ঠিক এ রকম একটি সময়েই রূপার জীবনে এল এক বিষণ্ন যুবক। ধরা যাক, তার নাম আটপৌরে। এই নামও অবিশ্বাস্য? কী করব বলুন, এটাও যে রূপার ভাষ্য! ঠিক আছে, দুটো নাম যেহেতু বদলে দিলাম, এটাও দিই। ধরা যাক, এই যুবকের নাম রাশেদ। তো, রাশেদ এতই সাধারণ, সাদামাটা আর আটপৌরে যে, অন্তত রূপার জীবনে আসার মতো যোগ্যতা সে ধারণ করে না। রূপার পছন্দ উজ্জ্বল-ঝলমলে-প্রাণবন্ত যুবক। সেই বিবেচনায় মামুনের তুলনায় রাশেদ কিছুই না। একেবারে কিছুই না। রাশেদ তাদের বন্ধু-বৃত্তের বাইরের মানুষ, কখনো কাছ থেকে তাকে দেখার সুযোগ হয়নি রূপার। দু-একবার দূর থেকে দেখেছে বটে, পরিচয়ও হয়েছে। কিন্তু এমনকিছু আকর্ষণীয়ও মনে হয়নি। চোখে পড়ার মতো কোনো গুণই তার নেই, রূপ তো নয়ই। ফলে রাশেদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করা তো দূরের কথা, কখনো তার কথা ভেবেই দেখেনি রূপা। ভাববেই বা কেন? সে তো তখন বুঁদ হয়ে আছে মামুনের প্রেমে। বুকের ভেতর হু হু কষ্ট। মনে হয়—সারাক্ষণ যদি পাশে বসে থাকা যেত, যদি তাকে একবার নিজের করে পাওয়া যেত! চ্যাটরুম-ফেসবুক-স্কাইপির আড্ডা, সেলফোনে মুহুর্মুহু ক্ষুদেবার্তা আর বিকেলে অতি অবশ্যই দেখা হওয়া—তার পরও মনে হতো, কত দিন দেখা হয় না, কত দিন পাশে বসা হয় না! ছুটির দিনগুলোর জন্য তখন উন্মুখ হয়ে থাকত রূপা। এই ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের শহর থেকে একটু বাইরে বেরিয়ে প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য, আহা, কী যে মধুর! যেন কৈশোর ফিরে এসেছিল তার জীবনে—তেমনই চিনচিনে ব্যথা বুকজুড়ে, হাহাকার আর শূন্যতা, একদিনের দেখা না হওয়াকে অনন্তকাল মনে হওয়া। সেসব দিনের অস্থিরতার কথা মনে পড়লে এখনো বুক দুলে ওঠে রূপার! কী তুমুল প্রেমেই না পড়েছিল সে, অমন প্রেম বোধ হয় মানুষের জীবনে একবারই আসে। এমনকি নিজের সন্তানটির কথাও মনে থাকত না তার। সারা দিনে সে মাকে পেত না, রাতেও একাই ঘুমিয়ে পড়ত, কারণ মা তখনো ব্যস্ত আড্ডায়। আর বাবা তো তখনো ফেরেইনি! তার ছোট্ট মনটি অভিমানে ভরে উঠত, মার কাছে যেতে ইচ্ছে করত কিন্তু সাহস হতো না! মা যেন ক্রমশই অচেনা হয়ে উঠছিল। অল্প বয়সেই নিজের একাকিত্বের ব্যাপারটা সে বুঝে গিয়েছিল, হয়ে উঠছিল বিষণ্ন-চুপচাপ। কিন্তু ব্যাপারটি তখন রূপার চোখে পড়েনি। ওই আটপৌরে যুবকটিই প্রথম সেদিকে তার নজর ফেরায়—কিন্তু তত দিনে খোকার চোখেমুখে স্থায়ী বিষণ্নতার ছাপ পড়ে গিয়েছে—দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এই কথা আমাকে বলেছিল রূপা।
তিন
রাশেদের প্রেমটা ছিল ভিন্ন রকমের। প্রথম দেখাতেই রূপাকে সে মিলিয়ে নিয়েছিল ছোটবেলার এক রহস্যময়-রোমাঞ্চকর অনুভূতির সঙ্গে। আহা, কী যে মধুর সেই অনুভূতি! মনে পড়েছিল ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর, আর প্রীতিময় বাড়ির কথা। বাড়ির পেছনে ছড়ানো বাঁশবন। বাঁশঝাড়ের পাতায় পাতায় আধো অন্ধকার, দিনের প্রখর রোদেও গভীর ছায়াছন্নতা, আর কী যে শীতল! মায়াময় এক রহস্যময়তা যেন ঘিরে থাকে, চৈত্রের দাবদাহেও বড় শান্তি এখানে। পাতাগুলো বিরামহীন ঝিরঝিরে বাতাস দেয়, শীতলতা দেয় আর ফিসফিস করে কী যেন বলে! কিন্তু লোকজন বড় একটা আসে না এ দিকটায়। কত গল্প যে ছড়ানো, ভয় ধরানো সব গল্প, রাশেদেরও ভয় ভয় লাগে। তবু কী এক অমোঘ টানে সে বারবার চলে আসে এখানে। গা ছমছম করে, তবু নিজেকে ফেরানো যায় না!
ছোটবেলার সেই ভয় ভয় ভালোলাগা, সেই ব্যাখ্যাহীন রহস্যময়তায় ভরা রোমাঞ্চকর অনুভূতির দেখা সে পেয়ে যায় অনেক দিন পর, অন্যরূপে, অন্য অনুভূতিতে—যেদিন তার সাথে রূপার প্রথম দেখা হয়। আর তাই, আজও, এই এত দিন পরও রূপার কথা মনে হলেই ছোটবেলার এই কথাগুলো মনে পড়ে রাশেদের। রূপাও যেন ওই রকম—ছায়াছন্ন, মায়াময়, রহস্যময়। ওর কাছে যাওয়ার সময়, এমনকি ওর কথা মনে হলেও বুকের ভেতরটা কেমন শিরশির করে ওঠে, সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে, তবু নিজেকে ফেরানো যায় না!
কীভাবে রূপার প্রেমে পড়েছিল সে, বলতে পারবে না! বলবে কীভাবে, সে তো নিজেই জানে না কখন কীভাবে ঘটে গিয়েছিল ঘটনাটা! শুধু মনে পড়ে, প্রথম দেখাতেই তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করেছিল মেয়েটি। কী এমন ছিল রূপার মধ্যে, কেন তাকে এক নেশা ধরানো ভালোলাগার অনুভূতি তাকে জাপটে ধরেছিল, এই নিয়ে অনেক ভেবেছে সে। উত্তর পায়নি। কিংবা যেসব উত্তর পেয়েছে, সেগুলো মনঃপূত হয়নি। রূপা দেখতে সুন্দর, কিন্তু ব্যাপারটি তো এমন নয় যে, পৃথিবীতে সে একাই সুন্দর বা তার মতো সুন্দর কোনো মেয়ে রাশেদ জীবনেও দেখেনি! দেখেছে, অনেক দেখেছে, কিন্তু তারা তাকে এভাবে আকর্ষণ করতে পারেনি। নিজের কাছে এই ঘটনার ব্যাখ্যা সে দিতে পারেনি বলেই হয়তো রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটি খুব মনে ধরেছিল রাশেদের— ‘পৃথিবীতে অনেক মুখ চোখে পড়ে, কিন্তু এক-একটি মুখ বলা-কহা নাই একেবারে মনের মধ্যে গিয়া উত্তীর্ণ হয়। সে কেবল সৌন্দর্যের জন্য নহে, আর-একটা কী গুণ আছে। সে গুণটি বোধ করি স্বচ্ছতা।’ রূপার বিষয়টিও হয়তো তা-ই। ‘বলা নাই কহা নাই, একেবারে মনের মধ্যে গিয়া উত্তীর্ণ’ হওয়ার মতো মুখ ছিল সেটি। সেই মুখে ছিল স্বচ্ছতা, আচরণে-আভরণে ছিল সহজতা। কিন্তু সব কিছুর পরও একটা আভিজাত্য তার সর্বাঙ্গ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছিল। এই আভিজাত্য পোষাকি আভিজাত্য নয়, এ অন্যকিছু। ব্যাখ্যা করা মুশকিল, রূপার কোনো কিছুই সে ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করতে পারে না। হয়তো রূপা সেই ধরনের মানুষ, যাদের সহজতার কারণে অনেক কাছের বলে মনে হয়, আর আভিজাত্যের কারণে মনে হয় দূরের। কাছের হয়েও দূরের। একটা ধাঁধার মতো। মনে হয়, এত সহজ-সরল এই মানুষটি যে, চাইলেই ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পাওয়া যাবে। পরমুহূর্তেই চোখ মেলে একটু তাকালেই মনে হয়—অনেক দূর থেকে হাসছে সে; নাগাল পাওয়ার উপায় নেই!
এই ধন্ধ থেকে বেরুনোর আগেই রাশেদের প্রেম গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগল। যেন এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না ওই অনির্বচনীয় মুখটি। কিন্তু সহসা দেখা হওয়ার মতো কোনো সম্পর্কও নেই তাদের মধ্যে। পেশাগত প্রয়োজনের সূত্রে সামান্য পরিচয়, অকিঞ্চিত্করই বলা যায়। এই শহরে সে এসেছিল ছবি আঁকার স্বপ্ন বুকে নিয়ে, চারুকলায় পড়াশোনা করার সুযোগও পেয়েছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই। জীবন-যাপন আর জীবন-ধারণের দায় মাথায় নিয়ে রঙ-তুলিকে প্রায় বিদায় জানিয়েছে সে। মন খারাপ হয়ে থাকে, গভীর অবসাদে জীবনজুড়ে বিষণ্নতা নামে। হয়তো তারই কিছুটা তুলে রাখে সে রঙতুলিতে, তার একাকী ঘরে। জীবনের অন্য সব জায়গার মতো পেশাগত জীবনেও সে এক কোণায় পড়ে থাকা মানুষ, তার কোনো সংঘ বা সঙ্গ নেই। রূপা ও তার বন্ধুদের অনেককেই চেনে সে। শুধু চেনাটুকুই, আর কিছু নয়। ওরা উজ্জ্বল, ওরা প্রাণবন্ত; রাশেদ নিজে সেখানে বেমানান। ওদের কাজকর্ম-ঘোরাফেরা আর দুর্দান্ত আড্ডাবাজি দূর থেকে দ্যাখে রাশেদ। সে ওই দলের সদস্য নয়, কাছে যাবার প্রশ্নও তাই ওঠে না। আবার এমন কোনো উপলক্ষ্যও আসে না কখনো যে, রূপার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। তবু, আবার একদিন দেখা হয়ে যায়। শহরটা ছোট। আর নানা সামাজিকতায় যাঁদেরকে এদিক-ওদিক যেতে হয়, তাঁরা জানেন—বিভিন্ন জায়গায় একই মানুষের দেখা পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়! এবং অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই যে, অপছন্দের মানুষের সঙ্গেই দেখা হয় বেশি, কাঙ্ক্ষিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয় কালেভদ্রে। এমনিতেও রাশেদ খুব একটা সামাজিক মানুষ নয়, যথাসম্ভব সামাজিক আয়োজন এড়িয়ে চলে, নিতান্তই বাধ্য না হলে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। কে জানে, রূপাও একই রকম কি না! সে তো প্রায় কিছুই জানে না রূপার সম্বন্ধে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজিতে সে যেমন উচ্ছল-প্রাণবন্ত, একলা থাকলে ঠিক তার উল্টো—প্রথম দেখায় এইটুকু মনে হয়েছিল তার। কিংবা রূপার সামাজিক জীবন আর রাশেদের সামজিক জীবন হয়তো সেতুর দুই প্রান্তের ব্যাপার। রূপার সঙ্গে তার ফের দেখা হতে তাই অনেকটা সময় লেগে যায়। মনে গেঁথে যাওয়া মুখটি এত দিন ধরে সে কেবল বয়েই বেড়িয়েছে, যোগাযোগের কোনো উপায় না থাকায় সেই কথাটি জানানোও হয়নি মেয়েটিকে। কিন্তু এত দিন পর দেখা হলে কী হবে, রাশেদ কোনো কথাই বলতে পারে না। মুগ্ধ চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে তার দেখা সবচেয়ে গর্জিয়াস মেয়েটির দিকে। কথা বলবেই বা কীভাবে, এমন একটি গর্জিয়াস মেয়ে যদি একটি অনুষ্ঠানে থাকে, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিনা চেষ্টায় সে হয়ে ওঠে কেন্দ্র, তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সব কিছু। রাশেদ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল—রূপার চারপাশে বহু মানুষের ভিড়, সবাই নক্ষত্র একেক জন। নক্ষত্রদের ভিড় ঠেলে সে রূপার দিকে এগোবে কীভাবে? রাশেদ সাধারণ মানুষ, অতি সাধারণ। প্রিয়তমা ফেলিসের কাছে কাফকা যেমন করে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন তার সেই বিখ্যাত চিঠিটিতে—‘রোগাক্রান্ত, দুর্বল, অসামাজিক, মৌন, বিষণ্ন, অস্বাভাবিক ও অস্বস্তিকর, প্রায় ব্যর্থ এক মানুষ, সম্ভবত যার একমাত্র গুণ, সে তোমাকে ভালোবাসে’—রাশেদ নিজেকে আবিষ্কার করে অনেকটা ওরকমভাবেই। কিংবা পুরোপুরি ওরকমও নয়, কারণ শেষ কথাটুকু বলার মতো সম্পর্ক তাদের নেই, হয়তো হবেও না কোনো দিন। তা ছাড়া, রূপাও মেতে আছে অন্যদর নিয়েই। খুব উচ্ছ্বাসমুখর নয়; মৃদু হাসি, সহজ ভঙ্গি আর চোখের ঝিলিক—এসব কিছুই তার উপস্থিতিকে উজ্জ্বল করে তুলবার জন্য যথেষ্ট। রাশেদ দেখল, কিছুটা অসহায়ভাবেই, রূপার চোখ বারবার নিবদ্ধ হচ্ছে একজন তারকার দিকে—মামুন তাঁর নাম। তিনি তারকা, তিনি উজ্জ্বল, তিনি আকর্ষণীয়, তিনি বিশিষ্ট—তাঁকেই ঘিরে থাকে মেয়েরা, তাঁকে তাই রমণীমোহনও বলা যায়; অথচ রূপার মনোযোগ পাবার চেষ্টায় কমতি নেই তাঁরও। রূপা যদি সাড়া দেয়-ই সেই চেষ্টায়, তাকে দোষ দেওয়া যায় না! আসলে যেখানেই প্রেম, সেখানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা—প্রাচীন নিয়ম; এবং যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেখানেই জয়-পরাজয়; আর একজনের জয় মানেই অন্য জনের হেরে যাওয়া। দুর্বলরাই হারে—এ-ও প্রাচীন নিয়ম! তার মন খারাপ হলো, বিনা কারণেই। সে তো যোগ্য নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী হবার মতো যোগ্যতাও তার নেই—লড়াই করা তো দূরের কথা; তবু কেন এ নিয়ে মন খারাপ হবে, এই ভেবে নিজেকে খানিকক্ষণ শাসনও করল। এবং এই বলে প্রবোধ দিল নিজেকে—তার দিকেও তো রূপা দু-একবার তাকিয়েছে, মিষ্টি হেসে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে; এর চেয়ে বেশি আর চাওয়ার কী থাকতে পারে?
অনুষ্ঠান শেষ হয়। এই সব অনুষ্ঠানের কোনো অর্থ বুঝতে পারে না রাশেদ। মানুষ খাওয়া-দাওয়ার জন্য এত পাগল থাকে, আশ্চর্য! কেবল বিশিষ্টরাই এগুলো উপেক্ষা করেন; যেমন মামুন; হয়তো, খাদ্যবস্তু ছাড়াও তাদের আরও অনেক কিছু পাওয়ার থাকে বলে। খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই এক এক করে যাওয়ার পথ ধরেছে। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকেই যেতে পারছে না। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। রাতও হয়েছে অনেক। যাদের গাড়ি নেই, তারা যাবে কীভাবে? রাশেদও তাদের মধ্যে একজন। তার ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। এটা যদিও অফিসিয়াল পার্টি এবং অফিস থেকেই গাড়ি পাওয়ার কথা ছিল তার, কিন্তু সব গাড়ি নানা কারণে ব্যস্ত থাকায় তার কপালে আর জোটেনি। তার বাসায় ফেরাটা তাই অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে রইল। রাশেদ দেখল, রূপাও চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বিদায় নিচ্ছে হোস্টদের কাছ থেকে।
চলে যাবে! দেখা হলো, অথচ একটা কথাও হলো না—এই বেদনা নিয়ে দ্বিতীয় দেখাপর্ব শেষ হওয়ার আগে রাশেদ প্রায় নিজের অজান্তেই মৃদু স্বরে রূপার ফোন নম্বর চেয়ে বসে। ব্যাপারটা শোভন নয়—সে জানে, স্বল্প চেনা একটি মেয়ের কাছে ফোন নম্বর চাওয়াটা রীতিমতো আরবান এটিকেটের সীমালঙ্ঘন, তা-ও জানে। সে অতটা অশোভন কাজ করার মতো অভদ্রও নয়। তবু সে নিজেকে সামলাতে পারে না। এবং বিস্ময়করভাবে এবং অতি অবশ্যই অপ্রত্যাশিতভাবে রূপা নিজের ফোনটি বের করে রাশেদকে বলে—‘আপনি আপনারটা বলুন, আমি কল করছি।’ রাশেদ নিজের নম্বরটি বললে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার ফোনটি বেজে উঠলে রূপা বলে—‘ওটাই আমার নম্বর, মিলিয়ে নিন তো! হ্যাঁ, ঠিক আছে। কথা হবে। দেখা হলে তো কথাই বলেন না, ফোনেই না হয় কথা বলা যাবে!’
রাশেদ বিস্মিত হয়েছিল, মারাত্ম বিস্মিত। কিন্তু সে তো আর রূপার চোখ দেখেনি। তার চোখে যেমন ছিল মুগ্ধতা, রূপার চোখেও হয়তো মৃদু মুগ্ধতা ছিল। এই সর্বদা মৌন, বিষণ্ন, আপাদমস্তক ভদ্রলোকটিকে তারও প্রথম দিনই চোখে পড়েছিল।
বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গিয়েও পরক্ষণেই রূপা ফিরে আসে আবার, বলে—আপনি বাসায় যাবেন না? রাত তো অনেক হলো। নাকি আরও কোনো কাজ আছে?
না, কাজ নেই। বাইরে তো অনেক বৃষ্টি, কমুক একটু, তারপর বেরুব।
রূপা একটু ভাবে, তারপর বলে—গাড়ি আনেননি আজকে, না?
রাশেদ একটু লজ্জা পায়। সে কীভাবে বলে যে, তার গাড়ি নেই! গাড়িওয়ালারা যে কেন সব সময় ভাবে—তাদের মতো সবারই গাড়ি আছে, সে বোঝে না। রূপা তাকিয়ে আছে, একটা কিছু উত্তর দিতে হয়, সে তাই আমতা-আমতা করে বলে—
না… মানে… আমার তো গাড়ি নেই। অফিস থেকেও গাড়ি পেলাম না আজকে!
ও! আচ্ছা চলুন, আপনাকে আমি বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
আপনার বাসা কোথায়?
উত্তরা।
আর আমি থাকি আজিমপুর। এই বনানী থেকে আপনার তো উল্টো পথে যেতে হবে!
তাতে কী? গল্প করতে করতে চলে যাব। ভালোই কাটবে সময়টা। আপনার সাথে তো কথাই বলা হয় না।
আর ফেরার সময়? এতটা পথ একা ফিরতে খারাপ লাগবে না?
নাহ। আমার অভ্যাস আছে। আমি মাঝে মাঝেই লং ড্রাইভে যাই। কেউ সঙ্গে থাকলে ভালো, নইলে একাই যাই।
সঙ্গে কেউ থাকে কখনো?—মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেই সে বুঝতে পারে, আরবান এটিকেট তার আর শেখা হলো না! এই সব ব্যক্তিগত প্রশ্ন তো করা নিষেধ। আর শিখবেই বা কীভাবে? মফস্বল থেকে মহানগরে আসা আউটসাইডার সে; শিল্পী হবার স্বপ্ন নিয়ে এখানে এসেছিল; কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে কিংবা শেষ করার আগেই সে বুঝে যায়—শুধু ছবি এঁকে জীবন চালানো অসম্ভব। তার এক শিক্ষক খুব ভালোবেসে বলেছিলেন—‘চাকরি-টাকরি তো করতেই হবে, কিন্তু ছবি আঁকাটা ছেড় না, বাবা। তোমার অসাধারণ ক্ষমতা আছে।’ সেই শিক্ষকের রেফারেন্সেই একটা বড় বিজ্ঞাপনি সংস্থায় চাকরি পায় সে। এখন তার পজিশন ভালো, বেতনও ভালো, তবু বাড়ির খরচ আর নিজের খরচ চালিয়ে বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না! আর ছবি আঁকা? সেটা এখন একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে গেছে। জীবনেও কোনো দিন একটা প্রদর্শনী করা হবে না বলে ধরেই নিয়েছে সে। একটা বিব্রতকর প্রশ্ন করে এই সব ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল সে, রূপার কথায় ঘোর ভাঙে। প্রশ্নটা রূপা খুব সহজভাবেই নেয়, বলে—
হ্যাঁ, মামুন ভাই, থাকে কখনো কখনো; নীলু থাকে। নীলু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
মামুন ভাই হচ্ছে সেই তারকা, রূপা তার পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না, তাকে কে না চেনে? কী সহজেই না রূপা কথাটা বলে ফেলল! ওর এই সহজতা অসাধারণ।
গাড়িতে উঠে স্বস্তিতে, আরামে রাশেদের ঘুম পেয়ে যায়। বাইরে তুমুল বৃষ্টি, ভেতরে হালকা এসির ঠান্ডা আমেজ, মিউজিক সিস্টেমে অজয় চক্রবর্তীর মৃদুকণ্ঠে গান, আর তার সাথে রূপার অবিরল কথা। যেন কত দিনের বন্ধুতা তাদের, যেন অনেক দিন পর দেখা হয়েছে, তাই কথার ঝাঁপি খুলে বসেছে। কথায় কথায় রাশেদের ছবি আঁকাার প্রসঙ্গও এল, এল তার শিক্ষকের প্রসঙ্গও। তিনি নানা জায়গায় বলে বেড়িয়েছেন—‘আমার এই ছাত্রটা অসম্ভব প্রতিভাবান। ও একদিন সবাইকে এই দেশের চিত্রকলার ইতিহাস নতুন করে লিখতে বাধ্য করাবে।’ রাশেদ ম্লান ও মৃদু হাসে; শিষ্যের প্রতি গুরুর এই অসামান্য শ্রদ্ধাবোধের দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই জগতে। অথচ সে এর মূল্য দিতে অক্ষম। জীবিকার জন্য গাধার খাটনি খাটা আর অবসর পেলে ছবি এঁকে ঘর ভরে ফেলা ছাড়া সে গত কয়েক বছরে কিছুই করেনি। শিল্পীদের একটা কমিউনিটি থাকে, সে এখন সেই কমিউনিটির বাইরে। রাশেদ এমনিতেই কম কথা বলে, রূপার নানা কথার প্রেক্ষিতেও সে খুব বেশি কথা বলল না। তা ছাড়া অজয় চক্রবর্তী এবার গাইছেন—‘হিমেল হাওয়া ডাক দিয়ে যায়, কাঙাল করে নিল কেড়ে সব আভরণ কোন ইশারায়’—তাঁর করুণ মায়ামায় কণ্ঠ বিষণ্নতা ছড়িয়ে দিচ্ছে চরাচরজুড়ে। মনটা আর্দ্র হয়ে উঠছে, চোখটাও ভিজে উঠতে চাইছে। এমনকি—‘রিক্ত শাখা আবার কবে পূর্ণ হবে, আমার এই শূন্য হূদয় কে ভরাবে, বসে থাকি তারই আশায়’—অংশটুকু শুনতে শুনতে তার চোখ ভরে ওঠে জলে! বৃষ্টিমুখর রাতে শীতের গানটাও এত ভালো লাগছে কেন, মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন অকারণে, কে জানে! পথটাও যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। বনানী থেকে আজিমপুর কি এতটা কাছে? এত তাড়াতড়ি যে পৌঁছে গেল! নাকি বৃষ্টির রাত বলে রাস্তাঘাট ফাঁকা ছিল?
বিদায় নিতে গিয়ে রূপার চোখেও বিষণ্নতা ভর করে। মেয়েটার চোখ-মুখ কথা বলে, সব কথা তাই মুখে বলতে হয় না। তবু যাবার সময় বলে—কথা হবে। ফোন করবেন, আমিও করব।
শুরুটা হয় ফোনেই। কথা দিয়ে নয়, এসএমএস দিয়ে। কত কথা যে তারা বলে ফেলে, কত কত ব্যক্তিগত গল্প বিনিময় করে, তার হিসেব নেই। তারপর খুব আয়োজন করে, এসএমএস-এ রীতিমতো সময় ঠিক করে রূপা এক রাতে ফোন করে রাশেদকে, আর কথা চলতে থাকে প্রায় সারা রাত। সবই হয়, কিন্তু দেখা আর হয় না!
এভাবে আজকাল আর প্রেম হয় না। এত ধীর-লয়ের প্রেম প্রাগৈতিহাসিক আমলে হতো। এখন মোবাইল ফোনের যুগ, ইন্টারনেটের যুগ, এসএমএস, যখন-তখন ফোন, ইমেইল-চ্যাট-ব্লগ-ফেসবুক—এসবই যেহেতু হাতের মুঠোয়, তখন দেখা হওয়ার জন্য এ রকম হাপিত্যেশ রীতিমতো অস্বাভাবিক। তবু তেমনই ঘটে। ঘটে হয়তো রাশেদের স্বভাবের কারণেই। আলাপটুকু তাদের ফোনেই হয়ে যায়। দেখা আর হতে চায় না।
চার
মামুন রূপাকে তীব্রভাবেই চাইত এবং এই চাওয়ার মধ্যে কোনো গলদ ছিল না। হয়তো এটা কেবল শরীরী চাওয়া ছিল না, ভালোও বাসত প্রবলভাবেই। কিন্তু রূপার আবেগটি বোধ হয় সে ঠিক বুঝতে পারত না। সে কেবল শুনতে চাইত—রূপা তাকে ভালোবাসে কি না! অন্য দিকে চলত ক্রমাগত স্তুতি—তার রূপের, তার শরীরের, তার যৌবনের! আর চলত অবিরাম চাওয়া! রূপা মনে মনে সব দিয়ে বসে আছে, শুধু একটু সমর্পণ, অন্য সবার থেকে চোখ ফিরিয়ে কেবল তার দিকেই তাকিয়ে থাকা, তাতেই নিজের সব কিছু ওই নক্ষত্রপুরুষের হাতে তুলে দিতে প্রস্তুত হয়ে ছিল মেয়েটির হূদয়-মন। অথচ, যখন কেবল হাত বাড়ালেই তাকে পাওয়া যায়, মামুন তখন ব্যস্ত নীলিমাকে নিয়ে! অনেক চেষ্টা করেও তাকে নীলিমামুক্ত করতে পারল না রূপা। প্রবল রাগ হলো তার, শূন্যতাবোধ গভীর হলো বুকের ভেতর। হয়তো সেই শূন্যতা কাটাতে, কিংবা মামুনের ওপর রাগ করে, কিংবা কী কারণে, কে জানে—রাশেদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হলো তার। কথাবার্তা মানে মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা, আগেই বলেছি বোধ হয়। অদ্ভুত সুন্দর সব মেসেজ পাঠাত রাশেদ, মুগ্ধ হয়ে বারবার পড়ার মতো, যেন প্রতিটি মেসেজই একেকটি কবিতা। রাশেদের শিল্পীসত্ত্বা সম্বন্ধে আগে থেকেই জানা ছিল রূপার। তার সমগ্র জুড়ে কেবল মামুন ছিল বলে, কিংবা রাশেদের দিকে আগে কখনো মনোযোগ দেওয়া হয়নি বলে তার এই গুণটিকে কখনো আমলে নেয়নি রূপা। এমনকি সে খুবই শোভনভাবে তার ভালোলাগার কথা জানানোর পরও নয়। সত্যি বলতে কি, রাশেদ কখনোই শোভনীয়তার মাত্রা অতিক্রম করেনি। ভালোলাগার কথা বলত সে, বলত আরও নানা বিষয়ে কথাবার্তা, রূপার প্রশংসা করত নম্রভাবে, তার রুচি ও ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করত, কিন্তু কখনোই রূপ নিয়ে কোনো কথা বলত না, শরীর তো দূরের ব্যাপার। বিষণ্ন আর নিঃসঙ্গ একজন মানুষ সে, কিন্তু কথা বলে বড় মনোহর ভঙ্গিতে—সেটা টের পাওয়া গেল একদিন প্রায় সারা রাত ধরে কথা বলার পর। খুব ধীরে, প্রায় নিজের অজান্তে, রাশেদের প্রতি ভালোলাগা জন্মাতে লাগল রূপার। কিন্তু মামুনের জন্য তার সর্বগ্রাসী প্রেম অনেক দিন পর্যন্ত ঢেকে রাখল এই চমত্কার ভালোলাগাটিকেও। এক জটিল মানসিক টানাপোড়েনে বিমূঢ় এক সময় পার হতে লাগল তার। অন্য দিকে রাশেদ কখনো আগ্রাসী ছিল না, হয়তো তার সাহসই ছিল না আগ্রাসী হবার। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে এই রকম টুকিটাকি কথাবার্তাতেই সীমাবদ্ধ রইল সম্পর্কটি।
ভাবছেন, কাহিনি এবার বলিউডি সিনেমার দিকে টার্ন নিয়েছে? ত্রিভুজ প্রেম থেকে চতুর্ভুজ প্রেমের আবির্ভাব ঘটেছে গল্পে! কী করব বলুন! দুজন মানুষের ভেতরে যদি যোগাযোগটা সঠিক মাত্রায় না হয়, যদি একই সুরে বেজে উঠতে ব্যর্থ হয় দুটি হূদয়, তাহলে দুজনের মধ্যে তৃতীয় কেউ ঢুকে পড়তে পারে, চতুর্থ পক্ষের আবির্ভাব ঘটা বিচিত্র নয়। গল্প তখন ত্রিভুজ-চতুর্ভুজ রূপ ধারণ করে, এমনকি পঞ্চভুজ-ষড়ভুজ রূপ পেলেও কিছু করার থাকে না। মামুন-রূপা পরস্পরের সঙ্গে সঠিকভাবে যোগাযোগটা স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে, টিউনিংটা হয়নি আর কি, তাই এত পক্ষের আনাগোনা!
রূপার নক্ষত্র-ঘোর কাটছিল না। সত্যি বলতে কি, কেটে যাবার মতো ঘোর সেটি ছিলও না। নইলে যে মেয়েটি প্রায় কৈশোর থেকে নিজের রূপ ও শরীর নিয়ে নানা জনের কাছ থেকে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শুনে বিরক্ত ও ক্ষিপ্ত, শরীরী কথা যে নিতেই পারে না, সে—‘তোমার শরীর দেখে আমার লোভ হয়’—ধরনের কথা শুনেও কি তার সঙ্গে সম্পর্কটি ধরে রাখতে পারত? শুধু কি তাই? এর চেয়েও ভয়াবহ ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেছে মামুন এবং রূপা লাজুক মুখে মৃদু হেসে সেগুলো গ্রহণও করেছে। দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
ছুটির দিন ছিল সেটি। অনেক দিন পর সেদিন বাদল বাসায় ছিল। থাকত না হয়তো, কিন্তু বেশ কিছু দিন বিদেশে ঘুরে এসে ওই দিনটি সে বিশ্রামের জন্য বেছে নিয়েছিল। সকাল থেকেই চলছিল রূপার সাথে তার খুনসুঁটি আর বাচ্চার সঙ্গে নানা খেলাধুলা। যেন পুরোনো দিনগুলো ফিরে এসেছিল আবার, এমনই রোমান্টিক আচরণ ছিল বাদলের। রূপার ভালো লাগছিল ঠিকই, কিন্তু মনটা একটু অস্থিরও হয়ে ছিল। থাকবেই বা না কেন? ওই দিনও যে বন্ধুদের আড্ডা হবার কথা! বাদল যে হঠাত্ করেই বাসায় বিশ্রাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে, আর এমন রোমান্টিক আচরণ শুরু করবে, ভাবতেও পারেনি সে। রাতে একদফা হয়ে যাওয়ার পরও সকাল থেকেই কানের কাছে তার ফিসফিস চলছে—
আমার সাধ মেটেনি। চল আরেকবার হয়ে যাক।
এই, কী শুরু করলে, হ্যাঁ! খোকা জেগে আছে, বুয়া আছে বাসায়…
আচ্ছা ঠিক আছে, খোকা ঘুমালে আরেকবার, ঠিক আছে?
সেটা পরে দেখা যাবে। এখন সর তো, কাজ করতে দাও।
এসব চলতে চলতেই তার মোবাইলে মেসেজ টোন বেজে ওঠে। মামুনের মেসেজ—‘তুমি কখন আসবে? আমার সব কিছু ফাঁকা লাগছে!’
রূপার মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু সে যায় কীভাবে? এত দিন পর বাদল বাসায়, তা-ও এমন রোমান্টিক মুডে, এই অবস্থায় কি বেরোনো যায়! মন উতলা হলেও নিজেকে সামলায় সে। উত্তরে লেখে—
আজকে আমি আসতে পারব না। মন খারাপ কর না, প্লিজ!
আসতে পারবে না মানে? কী হয়েছে? আসতেই হবে। এক্ষুণি এস।
পাগলামি কর না। খোকার বাবা বাসায়। কীভাবে আসি, বল?
আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। তুমি আস। প্লিজ, আস।
পাগলামি কর না! বুঝতে পারছ না কেন?
বুঝতে চাই না। তোমাকে না দেখলে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে।
অলক্ষুনে কথা বলবে না। খবরদার!
একশবার বলব। তুমি না এলে আমি সত্যি সত্যি মরে যাব!
রূপার বুকটা দুলে ওঠে। এমনভাবে ডাকছে, এই ডাক কি ফেরানো যায়? বেশি কিছু ভাবার সময় দেয় না নিজেকে, বাদলের কাছে গিয়ে বলে—আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি?
বাইরে? এখন? কোথায় যাবে?
রূপা বন্ধুদের আড্ডার কথা বলে, লুকায় না।
যেতেই হবে?
একটু যাব। এই ঘণ্টাখানেকের জন্য। যাই?
বাদলের মুখে একটা ছায়া পড়ে, তবু স্বাভাবিকভাবেই বলে—ঠিক আছে যাও। তাড়াতাড়ি এস।
রূপা কৃতজ্ঞবোধ করে। লোকটা আসলেই ভালো, তাকে কোনো দিন কোনো কিছুতে বাধা দেয়নি, তার কাছে কিছু জানতেও চায়নি কখনো। হয়তো রূপার নিঃসঙ্গতার ব্যাপারটি সে অনুভব করতে পারে, কিংবা হয়তো নিজে সময় দেয় না বা দিতে পারে না বলে অপরাধবোধে ভোগে, বাধা দেবে কীভাবে? তবে আজকে সে ‘না’ করতেই পারত! এ রকম দিন তো সচরাচর আসে না! রূপার মন একটু খচখচ করে, তবু নিজেকে ফেরাতে পারে না। মামুনের ডাক বড় অমোঘ। ছোট্ট করে মেসেজ পাঠায়—‘আসছি।’ ও-পাশ থেকে আসে আনন্দের অভিব্যক্তি। বেশ দ্রুতই সে পৌঁছে যায়। আড্ডা তখন মধ্যগগনে। তুমুল হুল্লোড় চলছে। তার মধ্যেই নক্ষত্রের সঙ্গে তার চোখে চোখে কথা বিনিময় হয়ে যায়। নক্ষত্র এগিয়ে এলে ফিসফিসিয়ে বলে—
এভাবে ডাক কেন? বোঝ না কিছু?
ডাকি কেন, তুমি বোঝ না?
রূপা মিষ্টি হাসে—না, বুঝি না, যাও!
আড্ডায় ঠিক সামিল হতে পারে না রূপা। মনের ভেতর থেকে অস্বস্তিটা যাচ্ছে না—বাদলকে বাসায় রেখে আড্ডায় আসাটা কি ঠিক হলো? দুপুরে একসাথে খাবে বলে সকালে নিজ হাতে রান্না করেছে সে অনেক দিন পর। বাদল অপেক্ষা করছে বাসায়। আর সে এখানে! ব্যাপারটা একটু কেমন যেন হয়ে গেল! ঘণ্টাখানেক পর সে বাসায় ফেরার জন্য উঠে পড়ে। সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। মাধবী এসেই বলে যাই! চলবে না, চলবে না। সে বুঝিয়ে বলে—
আজকে অনেক ঝামেলা বাসায়, অন্য দিন সারা দিন আড্ডা দেব।
আর তখন মামুন কানের কাছে এসে মুখ নামিয়ে বলে— আরেকটু থাক, আরেকটু।
আজকে না। অন্য দিন। প্লিজ।
যাবেই?
হুম। যেতে হচ্ছে। বোঝ না!
গিয়ে কী করবে?
কী আর করব? সংসার সামলাব।
আহা, কত সংসার সামলাও! জানি তো!
আজকে যে কর্তা বাসায়!
তো?
কী তো?
তো কী হয়েছে?
বাহ, কর্তা বাসায় থাকলে একটু এক্সট্রা কেয়ার নিতে হয় না?
কী রকম?
এই যেমন, সকালে উঠে রান্না করলাম।
এখন গিয়ে কী করবে?
একসঙ্গে খাব।
তারপর?
তারপর… রূপা হঠাত্ করেই যেন মামুনের প্রশ্নটি বুঝতে পারে। লাজুক হাসে সে—তুমি শুধু দুষ্টু কথা বল।
আমি আর কী বললাম?
বলেছ, আমি বুঝেছি।
তাহলে সরাসরিই বলি। করবে ওটা?
কী?—বুঝেও, বোকার মতো প্রশ্ন করে বসে রূপা।
কী আবার! সেক্স!
রূপা লজ্জা পায়।
করবে?—মামুনের লজ্জার বালাই নেই।
করতেও পারি।
পারবে?
মানে?
আমার কাছ থেকে গিয়ে স্বামীর সাথে সেক্স করতে পারবে? আমাকে ভাববে না তুমি? আমাকে মনে পড়বে না তোমার?
রূপা লজ্জাবনতমুখে চুপ করে থাকে।
বল।
কী বলব?
পারবে তুমি?
রূপা চোখ তুলে তাকায়, কী যেন খোঁজে মামুনের চোখে।
বলবে না?
কী বলব?
বল, আমাকেই কল্পনা করবে তুমি। শরীরটা শুধু অন্যের, তোমার ভাবনায় তোমার কল্পনায় সঙ্গমটা আসলে আমার সঙ্গেই হবে! বল!
রূপা চুপ করে থাকে।
আমাকে রেখে তুমি স্বামীর কাছে যাচ্ছ, আমি হিংসায় জ্বলে যাচ্ছি। এইটুকু শুধু বলে যাও। নইলে যেতে দেব না।
রূপা আবার মামুনের দিকে তাকায়, সেই চোখে মদিরতা, ঠোঁটে মিষ্টি এক টুকরো হাসি। মুখে না বললেও যা বোঝার, বুঝে নেয় মামুন। রূপার চিবুক আলতো করে ছুঁয়ে বলে—ঠিক আছে যাও। পরের দিন কিন্তু জিজ্ঞেস করব!
এক অচেনা ঘোর নিয়ে বাসায় ফেরে সে। এই এক মানুষ, যে তাকে প্রতিদিন নতুন নতুন ঘোর উপহার দেয়!
আরেক দিনের কথা। সেদিন ছিল ভ্যালেন্টাইন্স ডে, আর রূপা সেজেছিল অপরূপ ভালোবাসার সাজে। নীল শাড়ি, নীল চুড়ি, কানে নীল রঙের পাথর বসানো দুল, কপালে নীল একটা টিপ—মামুনের প্রিয় রঙ। এমনিতেই সে ভীষণ আকর্ষণীয়, এই সাজে যেন হয়ে উঠেছিল পরম কাঙ্ক্ষিত। মামুনের প্রায় মাথা খারাপ হবার দশা হলো। একের পর এক ছবি তুলে চলল সে। কিন্তু সাধ মিটছিল না। এই মেয়েটিকে একবারের জন্যও পাওয়া হলো না, এই দুঃখ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। কীভাবে যেন পিছলে যাচ্ছে মেয়েটা। নাহ, আর সুযোগ দেওয়া যাবে না। এইবার শক্ত করে ধরতে হবে। একান্তে পেতে হবে। হবেই। কিন্তু এই মুহূর্তে তো আর সেটি সম্ভব নয়। এক বন্ধুর বাসায় আড্ডা বসিয়েছে তারা, এত লোকের মধ্যে তো কাজটা করা যায় না। কিন্তু সাধ যে মিটছে না! নিরুপায় হয়েই সে রূপার কানের কাছে মুখ নেয়—
তোমার বুকের ছবি তুলি?
অ্যাই, খবরদার, না!
না কেন? তোমাকে তো পাই না। অন্তত ছবিগুলো দেখে সান্ত্বনা পাব।
ছবি তো তুলছই।
বুকের ছবি তুলব।
ফাজিল—কটাক্ষ হানে রূপা। কিন্তু কোনো এক ফাঁকে রূপা পাশের রুমে গেলে সুযোগ বুঝে মামুনও পিছু নেয়। খোলা বুকের ছবি তোলার সুযোগ না পেলেও ব্লাউজের ফাঁকফোঁকর দিয়ে উঁকি দেওয়া উপচানো স্তনসহ রূপার হাসিমুখের ছবি ধরা পড়ে তার ক্যামেরায়!
এই ঘটনাগুলো শুনে নিশ্চিতভাবেই আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, রূপা এসব কিছু মামুনের জন্য অনুমোদন করত কেন? এগুলো তো অনুমোদন করা যায় শুধু প্রেমিকের জন্য, প্রেম হবার পরে! এই প্রশ্নের মুখোমুখি রূপা কোনো দিন দাঁড়াতে চায়নি। ওদিকে নীলিমার তীক্ষ আক্রমণে বিপর্যস্ত হবার মতো ঘটনা ঘটছিল একের পর এক, অন্য দিকে রাশেদের মায়াময় প্রেম—সব মিলিয়ে খানিকটা অচেনা ও বিমূঢ় অনুভূতির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে, হয়তো সইতে না পেরেই, রূপা আচমকা একদিন মামুনকে রাশেদের কথা বলে ফেলে। এরপর একের পর এক নিয়ন্ত্রণহীন ঘটনা ঘটতে থাকে। নীলিমার বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে, নাকি রাশেদের কথা শুনে ঈর্ষান্বিত হয়ে, নাকি রূপার মন রক্ষার জন্য, কে জানে—মামুন প্রায় বোমা ফাটানোর মতো কাণ্ড ঘটায়। নীলিমার নানাবিধ অপকীর্তি ফাঁস করে দেয় সে। ভার্চুয়াল জগতে শুরু হয় তুমুল আলোড়ন। আলোচনার কেন্দ্রে নীলিমা থাকলেও প্রাসঙ্গিক হিসেবে বারবার উঠে আসে রূপার নাম, এমনকি অপ্রাসঙ্গিক হলেও রাশেদের নামও। রূপা ভীষণ বিব্রত হয়, কুঁকড়ে যায় নিজের ভেতর—ঘটনা যে এত দূর গড়াবে, এ কথা সে ভাবতেও পারেনি। এই নোংরা আলোচনায় বারবার তার নাম আসায় রীতিমতো অসুস্থ বোধ করতে থাকে সে। এ এক অদ্ভুত জগত্। সামনাসামনি যে লোকটা ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকে—ভার্চুয়াল জগতে সে যে কী ভয়ংকর আচরণ করতে পারে, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করানো কঠিন—আমাকে এই কথা বলেছিল রূপা। এর পরের ঘটনা একটু অদ্ভুত। নানা কান ঘুরে কথাগুলো রাশেদের কানে পৌঁছানোর পর হঠাত্ই সে নীরব হয়ে যায়। ‘আমার একান্ত ব্যক্তিগত কথাগুলো আপনি এভাবে হাটবাজারে চাউর করে দেবেন, এটা আশা করিনি। আপনার সঙ্গে কথা বলাটা কি আমার অপরাধ হয়ে গেল?’—এইটুকু বলে প্রায় সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় রাশেদ। আর তখনই রূপা টের পায়—এই বিষণ্ন মানুষটিকে সে ভালোবেসে ফেলেছে আর তাই তার হঠাত্ নীরবতায় বুকের ভেতরটা যেন শূন্য হয়ে গেছে। টের পেয়েও ফের যোগাযোগ করার সাহস হচ্ছিল না রূপার। শান্ত, নিরুপদ্রপ মানুষদের তার ভয় লাগে। চঞ্চল প্রকৃতির মানুষেরা দ্রুত সব কিছু ভুলে যায়, শান্তরা একবার ক্ষেপে গেলে তাদেরকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কঠিন! রূপার কষ্ট হলো খুব, হলো গ্লানিবোধ। তার জন্য এই নিরীহ-শান্ত মানুষটিকে অহেতুক কতগুলো নোংরা কথা চালাচালির ভেতরে পড়তে হলো! এই কষ্ট নিয়েই কাটল বেশ কিছু দিন।
রাশেদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলেও মামুন কিন্তু দৃশ্য থেকে হারাল না। বরং এই সব ঘটনা-দুর্ঘটনার ভেতরে রূপার পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে সে তার প্রেমকে আরও পাকাপোক্ত করে জানান দিল। এত কথা চারপাশে, এত হট্টগোল তবু তাদের বন্ধুবৃত্তের আড্ডা চলমানই রইল, বরং আগের চেয়ে তা হয়ে উঠল আরও উষ্ণ ও আন্তরিক, নীলিমা ইস্যুতে তপ্ত আলোচনায় মুখর। রূপার মন তখন ভীষণ দোলাচলে কাতর। একদিকে রাশেদের প্রতি মায়াটা কাটানো যাচ্ছে না, বরং যেন বেড়েই চলেছে; অন্য দিকে মামুনের প্রতি প্রবল আকর্ষণ আর গভীর প্রেম অনুভব করা সত্ত্বেও তার ওপর ঠিক আস্থা ও বিশ্বাস রাখা যাচ্ছে না! এ রকমই এক জটিল মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সময় কাকতালীয়ভাবে দুজনকে পাশাপাশি দেখার সুযোগ পেল রূপা। এবারও পার্টিতেই। এবারও তারকারা থাকেন, থাকে রূপা, থাকে রাশেদও তার ম্লান-ম্রিয়মাণ উপস্থিতি নিয়ে। সেই দেখায় একটা বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল। পরে, তাদের প্রেম হবার পর, রূপা বলেছিল। সেদিন নাকি মামুন আর রাশেদের সঙ্গে তুলনা করেছিল রূপা এবং রাশেদকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শোনার পর খুব অবাক হয়েছিল রাশেদ, তারকা মামুনের সঙ্গে তার তুলনাই চলে না। তবু কেন রূপা তাকেই বেছে নিয়েছিল? মামুনও যে রূপার বিবেচনার মধ্যে ছিল, সে তো বোঝাই যাচ্ছে; নইলে তুলনার প্রসঙ্গটি আসত না। রূপার মনের খুব গভীরে মামুনের জন্য একটা জায়গা আছে, হয়তো খুব প্রেমময়-মায়াময়-স্পর্শকাতর সেই জায়গাটি—বোঝে রাশেদ। সেটাই তো স্বাভাবিক। মামুনের সঙ্গেই তাকে মানায়, কিন্তু রাশেদ কেন? তাকে কেন বেছে নিল রূপা? এই প্রশ্নের উত্তর সে পায়নি, রূপাও কিছু বলেনি এ ব্যাপারে।
কী ঘটেছিল সেদিন, রাশেদ সেটা বুঝতে না পারলেও, রূপার জন্য সেটি ছিল বিশেষ একদিন। রাশেদ সাধারণত কোনো অনুষ্ঠানে আসে না। অফিসিয়াল বাধ্যবাধকতা থাকলে ভিন্ন ব্যাপার, কিন্তু এমনিতে রূপা তাকে কোথাও কোনো আড্ডা বা অনুষ্ঠানে দেখেনি কখনো। সেদিন দেখে তাই ভীষণ আপ্লুত হয়েছিল। মাঝখানে ঘটে যাওয়া নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় বিপর্যস্ত ও ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের জন্য মন পোড়ানো একটা অনুভূতি ছিল, নইলে রাশেদকে দেখে এত আবেগপ্রবণ হবার কথা নয় তার। তা ছাড়া পাশাপাশি দুই প্রেমিককে পেয়ে সারাক্ষণ দুজনের তুলনামূলক বিচারের সুযোগ পেয়েছিল সে। মামুন—উজ্জ্বল-আকর্ষণীয়-প্রাণবন্ত-সজীব-আড্ডামুখর, যেমন পোশাকে-আশাকে দৃষ্টিনন্দন, তেমনি কথাবার্তায় চৌকস, অনেকের মাঝে থাকলেও যাকে খুব সহজেই আলাদাভাবে চোখে পড়ে; নক্ষত্ররা যেমন হয় আর কি! রাশেদ—ম্রিয়মাণ-সাধারণ-বিষণ্ন-নির্জীব-নির্জন, পোশাক-আশাক-কথাবার্তা কোনো কিছুতেই চৌকস নয়; আর দশ জন মানুষ থেকে তাকে আলাদা করার কোনো উপায়ই নেই; আটপৌরেরা যেমন হয় আর কি! এসব দিক বিবেচনা করলে নিজের জন্য মামুনকেই পারফেক্ট চয়েস বলে রায় দেবে রূপা, তার মনটাও তাই ওদিকেই ঝুঁকে রইল। কিন্তু ওগুলো ছাড়াও যেন সেদিন তার আরও কিছু দেখার ছিল। গভীরভাবে লক্ষ করছিল বলে চোখে পড়ল—মামুনের চোখ ভীষণ রকম অস্থির আর চঞ্চল, যেন কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ, যেন কিছুতেই স্থির হচ্ছে না মুহূর্তের জন্যও, এবং চোখ অনুসরণ করে তাকালে দেখা যায়—ওদিকে কোনো এক লাস্যময়ী রূপসী তরুণী দাঁড়িয়ে বা বসে আছে! মাঝে মাঝে তার চোখ রূপার দিকে ফিরছে বটে, কিন্তু নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, ফিরছে তার দিকে নয়, তার বুকের দিকে! অন্য দিকে রাশেদের চোখ উদাসীন ও গভীর, মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক তাকালেও যেন নির্দিষ্টভাবে কিছুই দেখছে না, বরং মগ্ন হয়ে চেয়ে আছে রূপার অনিন্দ্যসুন্দর মুখের দিকে, যদিও চোখাচোখি হতেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল সে। রূপা সেদিন ছিল পর্যবেক্ষণপ্রবণ—রাশেদের চোখে তাই আবিষ্কার করল অভিমান ও সমর্পণ, যুগপত্ভাবে। বুঝে নিল, এই আটপৌরে লোকটির জীবনে সে ছাড়া আর কেউ নেই। তার মন হু হু করে উঠল। আহা! এমন সমর্পণকে সে অবহেলা করে! কেমন মেয়ে সে!
অনুষ্ঠান শেষ হবার অনেক আগেই রাশেদ সেদিন চলে গিয়েছিল আরেকটি কাজের অজুহাতে, রূপার সঙ্গে একটি কথাও না বলে! যেন কোনো দিন তাদের সঙ্গে কোনো কথা বিনিময় হয়নি, যেন তারা চিরকালের অচেনা। আর সে চলে যেতেই রূপার জগত্টা যেন শূন্য হয়ে গিয়েছিল। কারও কোনো কথাই কানে যাচ্ছিল না, এমনকি মামুনের মধুমাখা স্তুতিগুলোও!
পরদিন সাহস করে রাশেদের কুশল জানতে চেয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠাল রূপা, আবার। সংক্ষিপ্ত উত্তরও এল, সেই সাথে ফিরে এল আশা। উত্তর যখন দিয়েছে, তখন, আজ হোক-কাল হোক রাগ পড়বেই। হলোও তাই। রূপার অব্যাহত চেষ্টায় রাশেদ আবারও ফিরল তার পুরোনো রূপে। আর এই দ্বন্দ্বসংকুল সময়টি পাড়ি দিতে-দিতেই তাদের ভেতরে সম্পর্কটি গড়ে উঠল। প্রেম! আহা কী মধুর শব্দ! আর রাশেদকে যতটা নির্লিপ্ত, উদাসীন আর আবেগহীন মনে হয়েছিল, প্রেম হবার পর দেখা গেল তার পুরোপুরি উল্টো চরিত্র! গভীর আবেপ্রবণ, রূপার প্রতি ভয়াবহ ডেডিকেটেড আর কেয়ারিং, আর তীব্র-কূলপ্লাবি প্রেমে ভরপুর এক মানুষ সে! সত্যিই, তার পৃথিবীজুড়ে রূপা ছাড়া আর কেউ নেই। এমন প্রেমই তো চেয়েছিল রূপা!
প্রেম হওয়ার জন্য দুজন মানুষ পরস্পর পরস্পরের ভেতরে বিশেষ কিছু একটা খুঁজে পায়, খুঁজে নেয়। রাশেদ সেটা খুঁজে পেয়েছে। রূপার অদ্ভুত সহজতা আর সৌন্দর্য, আভিজাত্যের মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠা সরলতা, আরও কত কী! কিন্তু রূপা কী পেয়েছে তার ভেতরে? সেটাও জানা হয়নি। রূপা এসব নিয়ে কথা বলতেই চায় না। চাইবেই বা কেন? সমস্যা যে পিছু ছাড়ে না তার! এ রকম একটা প্রেমে জড়িয়েও আড্ডার নেশা গেল না রূপার, এমনকি মামুনের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণও এতটুকু কমল না! বিপদেই পড়ে গেল সে। এক দিকে চলতি পথে, না চাইতেই, অপ্রত্যাশিত কুড়িয়ে পাওয়া প্রেম, অন্য দিকে বন্ধু ও আড্ডা ও অচরিতার্থ প্রেম। দুটোই তাকে টানে, দুটোকেই সময় দিতে হয়! কিন্তু এত দিনের অভ্যাস, আড্ডা ছেড়ে সে কীভাবেই বা অনুগত প্রেমিককে এতটা সময় দেয়? রাশেদ তার সবই জানত, বুঝত, কিন্তু খুব কম সময়ই এসব নিয়ে কথা বলত।
পাঁচ
যা-ই ঘটুক না কেন, রাশেদের কল্পনার জগিট ছিল অবারিত আর বহুবর্ণিল। রূপার অবহেলা, অমনোযোগ আর এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখেও তার সারাটি ক্ষণ কাটত রূপার ভাবনায়।
এই তৃতীয় দেখার পরই সব কিছু যেন পাল্টে গিয়েছিল। এর কারণও আছে। একটি ঝড়ের পর যেমন প্রকৃতি শান্ত, গভীর আর মায়াময় হয়ে ওঠে, নীলিমা-বিপর্যয়ের পর দীর্ঘ বিরহ, আর তারপর আবার মিলন তাদের সম্পর্ককে সেই রকম মধুময় করে তুলেছিল। আর রাশেদের অজান্তেই ওই দিন রূপার ওই তুলনামূলক বিচার—মামুন বনাম রাশেদ—এবং কোনো এক ব্যাখ্যাহীন কারণে রাশেদের জয়; এই সবই আগের সব কিছুকে বদলে দিয়েছিল। রাশেদের ঘরকুনো স্বভাব, নির্জনতায় থাকার স্বভাব, একা থাকার স্বভাব সবই পাল্টে গেল। রূপাই তাকে নিয়ে ঘুরতে লাগল যত্রতত্র। তার বন্ধুর অভাব নেই, সব জায়গাতেই সে রাশেদকে নিয়ে যেতে চায়; কিন্তু রাশেদ দু-একবার গিয়ে দেখেছে—সে সহজ হতে পারে না! এদের জগত্ আলাদা, রাশেদের সেই জগতে প্রবেশাধিকার নেই। তবে রূপা যখন একা কোথাও নিয়ে যায়, তখন ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে। তার মৌনতা আর বিষণ্নতাও সেদিন দূর হয়ে যায়!
একদিন রূপা আবদার করে বসে—আমাকে তুমি কোথাও নিয়ে চল না! তোমাকে আমি একান্তে কাছে পেতে চাই!
রাশেদ বিপদে পড়ে। রূপাকে একান্তে কাছে পাবার সাধ তারও হয়, খুবই হয়; কিন্তু তেমন জায়গা কোথায়? নিজের বাসায়? না, সেটা কীভাবে সম্ভব? একটা অ্যাপার্টমেন্টে তারা দুই কলিগ থাকে; পারফেক্ট ব্যাচেলর কোয়ার্টার। কলিগের সামনে সে রূপাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকবে কীভাবে? ব্যাপারটা তো রাষ্ট্র হয়ে যাবে! তাহলে কোথায় যাবে? কোনো বন্ধুর বাসায়? না, তা-ই বা হয় কীভাবে? ওরা যে ভাষায় এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে, কান পাতাই দায়! একইভাবে তার অনুপস্থিতিতে যদি ওরা রূপাকে নিয়েও কথা বলে? রূপার সম্মান কি এভাবে ক্ষুণ্ন করা যায়? না, এটাও সম্ভব নয়। কিন্তু সে তো আর কিছু চেনেও না। এই শহরে নাকি অনেক রকম রেস্ট হাউজ, গেস্ট হাউজ আছে। শহরের বাইরে একটু দূরে নাকি নানা রকম কটেজ আছে। এ সবই তার শোনা কথা। কিছুই সে চেনে না, জানেও না এ সম্বন্ধে। কাউকে জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ হয়। এদিকে রূপা বলেই চলেছে—কোথাও নিয়ে চল, নিয়ে চল।
দিশে না পেয়ে সে বলে বসে—আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাবে?
গ্রামের বাড়ি?
হ্যাঁ, পদ্মার পাড়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি। বড় সুন্দর, বড় মনোরম!
বাড়িতে যাঁরা আছেন, তাঁদের কী বলবে?
অসুবিধা হবে না, শুধু মাকে কানে কানে বলব—এই মেয়েটা আমার বউ, গোপনে বিয়ে করেছি, অন্য কাউকে এখনই বল না। একটা প্রশ্নও না করে মা-ই সব ব্যবস্থা করবে।
সত্যি, তুমি বলবে এ কথা?
হ্যাঁ বলব।
আবার বল তো কথাটা!
কোন কথা?
মাকে যেটা বলবে।
বলব—এই মেয়েটা আমার বউ।
রূপা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, অনেক ক্ষণ মুখে কোনো কথা নেই। তারপর ঘোরগ্রস্ত কণ্ঠে বলে—কী যে সুন্দর লাগল শব্দটা, তোমার মুখে! আমি যাব।
কবে যাবে?
যেদিন নিয়ে যাবে, সেদিনই যাব।
শোন, একেক সময়ে যাওয়ার একেক মজা। ভরা বর্ষায় যদি যাও, তাহলে দেখবে মাঠ-ঘাট ডুবে আছে বর্ষার পানিতে। পদ্মাপাড়ের গ্রাম তো, বর্ষায় পাড় ভেসে যায়, পানি ঢুকে পড়ে মাঠে-খালে-বিলে-পুকুরে। তখন কেবল পানি ছাড়া আর কিছু নেই। আর জোত্স্না রাতে সেই দিগন্তবিস্তৃত জলের ওপর যখন বাতাসের হুটোপুটি শুরু হয়, তখন মনে হয়, জোত্স্নার ঢেউ উঠেছে। মাখন রঙের সেই জোত্স্না-ঢেউ কখনো কোনো রঙ-তুলিতে ধরা দেয় না, জান! আবার যদি বর্ষার শেষ দিকে যাও, শরতের সময়; দেখবে, নদীর পাড়জুড়ে কাশবনে ধবধবে সাদা ফুলের বাহার। আচ্ছা, তুমি কখনো কচুরিফুল দেখেছ? সেটাও দেখতে পাবে ওই সময়। কচুরিফুলের রঙটা একটু বেগুনি; না ঠিক বেগুনি নয়, একটু নীলাভ; না ঠিক তা-ও নয়; নীল-সাদা-বেগুনির একটা মিশ্রণ; না… মানে বোঝানো মুশকিল। জান, আমি কখনো আমার রঙ-তুলিতে কচুরিফুলের রঙটাকে ধরতে পারিনি। এমনকি কাশফুলের সাদাকেও না। আবার ধর, যদি শীতের সময় যাও, দেখবে, কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে সারা গ্রাম ঘুমাচ্ছে। কুয়াশার রঙটাও কেমন যেন ধাঁধাময়, আঁকা যায় না; আসল রূপটা ধরা যায় না। কিংবা ধর, যদি বসন্তে যাও, দেখবে, কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলফুল ফুটে আছে। দুটোই লাল ফুল, কিন্তু একই রকম লাল নয়। কিংবা ধর সর্ষে ফুলের কথা। দেখবে, মাঠের পর মাঠ কেবল হলুদ আর হলুদ। এ রকম অপার্থিব দৃশ্যের জন্ম এই পৃথিবীতে হয় না। জান, আমি কখনো এই হলুদ, শিমুলের লাল বা কৃষ্ণচূড়ার লালকেও ধরতে পারিনি। কবিতা সম্বন্ধে একটা কথা আছে না—কবিতা হচ্ছে সেই শিল্প, যা অনুবাদে হারিয়ে যায়! আমার কী মনে হয়, জান? প্রকৃতির এই বিবিধ রঙ হচ্ছে সেই রঙ, যা রঙ-তুলিতে ধরতে গেলে হারিয়ে যায়!.
রাশেদের কথা চলতে থাকে, সবই প্রকৃতি আর তার রঙ নিয়ে। আকাশ, মেঘ, চাঁদ, জোত্স্না, গাছ, পাতা, ফুল, নদী, পাখি, ফল আর সব কিছুর রঙ, আর এসব কিছু রঙ-তুলিতে ধরতে না পারার ব্যর্থতার কথা!
রূপা মুগ্ধ হয়ে শোনে, আর অনুভব করতে পারে—কেন তার শিক্ষক, দেশের খ্যাতিমান এক শিল্পী তিনি, রাশেদ সম্বন্ধে ওই রকম কথা বলেন। রূপা কখনো রাশেদের কাছে আঁকাআঁকি সম্বন্ধে, রঙ আর তুলি নিয়ে এত কথা শোনেনি। বলা ভালো—এসব নিয়ে সে প্রায় কথাই বলে না; আর তাই বোঝা যায় না—কী আগুন সে ভেতরে বয়ে চলেছে!
রূপা বলে, আমাকে নিয়ে চল।
তখন বর্ষার শুরু। রাশেদ গাড়ি নিতে বাধা দেয়, বলে—একটু কষ্ট করে বাসে চল কিছু দূর। তারপর নৌকায় করে নিয়ে যাব।
নৌকায়?—রূপা রোমাঞ্চিত হয়। আবার ভয়ও পায়—ডুবে যাবে না তো!
আরে নাহ, হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করছে না?
গাড়িতেও যাওয়া যেত, রাস্তাঘাটও খারাপ না, কিন্তু রাশেদ ইচ্ছে করেই ঘুরপথে প্রথমে ঝিটকা গেল। সেখান থেকে শ্যালো-নৌকায় চড়ল আন্ধারমানিক যাবে বলে। এক-মাল্লার নৌকা পেলে ভালো হতো, কিন্তু সেগুলো বোধ হয় আর চলে না। নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে, আর পুরোনো পেশাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। এক-মাল্লার কেরায়া নৌকাগুলো কত রোমান্টিক ছিল! দুজন মিলে উঠলে শুয়ে-বসে, গল্পগুজব করে হেলেদুলে চলে যাওয়া যেত। সবই হারিয়ে যাচ্ছে আসলে। কী আর করা! তারা দুজন গলুইয়ের কাছে গিয়ে বসে। বর্ষা বলে পদ্মার থেকে পানি এসে ইছামতী ভরে দিয়েছে; এই নদী বর্ষার কয়েক মাস ছাড়া প্রায় সারা বছরই শুকনো থাকে। ইছামতী ছেড়ে নৌকা মোল্লার খালে ঢোকে। খালেরও এখন ভরা যৌবন, কানায় কানায় পূর্ণ জল। খালের দুই পাশে বাড়িঘর, গাছপালা। গাছের ডালগুলো যেন নুইয়ে এসে তাদের দুজনকে অভিবাদন জানাচ্ছে—এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেমেয়েরা নাইতে নেমেছে, হুল্লোড় করছে। নেমেছে যুবতী মেয়েরাও। কেউ কেউ বুকের আঁচল ফেলে পুরুষ্টু স্তন ধুয়ে নিচ্ছে সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করেই। তেমনই একজনকে দেখিয়ে রাশেদ রূপাকে বলল—এই মেয়েটির বিয়ে হয়েছে, বাচ্চাও হয়েছে, এবং সম্ভবত অল্প কিছু দিন আগেই হয়েছে, কয়েক মাস বলতে পার…
তুমি বুঝলে কী করে? মেয়েটাকে চেন?
নাহ।
তাহলে? মেয়েটার বয়স তো অল্প। বিয়ে হয়েছে, বাচ্চাও হয়েছে, তুমি এত সারটেইনলি বলছ কীভাবে?—রূপা অবাক গলায় বলল।
হ্যাঁ, মেয়েটার বয়স অল্প। গ্রামে তো অল্পবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে হয়। কিন্তু খেয়াল করে দেখ, ওর সমবয়সী মেয়েরা কেউ বুক খুলে গোসল করছে না। ও করছে। সন্তান হওয়ার পর ওরা আর স্তনকে যৌনতার বিষয় বলে মনে করে না, শিশুরা খায় বলে পবিত্র হিসেবে গণ্য করে। তাই অত রাখঢাক নেই; অবিবাহিতদের সেটা আছে। যুবতীদের উন্মুক্ত স্তন যৌনতার আবেদন তৈরি করে বটে, কিন্তু সেই স্তনবৃন্তই যদি একটা শিশুর মুখে থাকে তাহলে সেটি স্বর্গীয় পবিত্রতার অনুভূতি তৈরি করে। প্রশ্ন হচ্ছে, একই স্তন তুমি কীভাবে ব্যবহার করছ, তার ওপরেই নির্ভর করছে শিল্পের ব্যাখ্যা।
এই সব গল্প করতে করতে তারা পৌঁছে যায় বাড়ি। উচ্ছ্বাসময় সম্বর্ধনা, খাওয়া-দাওয়া, আর কিছুক্ষণ বিশ্রাম শেষে রূপাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয় রাশেদ। প্রথমেই নিয়ে যায় বাড়ির পেছনে সেই ঘন বাঁশবনে, পড়ন্ত দুপুরে সেখানে এখন গভীর ছায়াছন্নতা। অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ায় ওখানেই। রাশেদের বাঁধ যেন ভেঙে গেছে, অজস্র কথা বলে চলেছে; এখন সে-ই কথক আর রূপা শ্রোতা। মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো সব কথা বলছে রাশেদ। যেন বিজ্ঞাপনি সংস্থার এক্সিকিউটিভের পোশাকটি খুলে ফেলেছে সে, বেরিয়ে এসেছে তার শিল্পীরূপ।
তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে এলে তারা যায় পদ্মার পাড়ে। বর্ষায় পাড়-ছোঁয়া জল, যেকোনো মুহূর্তে উপচে উঠে ঢুকে পড়বে মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে। তখনই হবে চোখ-জুড়ানো জলমগ্ন বর্ষা। পদ্মা এখন রাগী, গর্জন করছে, বড় বড় ঢেউ উঠছে, জলের স্রোত এসে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। ‘প্রস্তুত হও, এই এলাম বলে তোমাদের মাঠ-ঘাট ভাসাতে’—এ রকম একটা ভাব। তারা স্তব্ধ হয়ে পদ্মার রূপ দেখে।
তারপর এক সময় সমগ্র পশ্চিম আকাশ লাল করে সূর্য ডুবে গেলে আকাশটা আবির রঙে সাজে; আর পৃথিবী ভরে যায় কনে দেখা আলোয়! এই সব রঙের কি কোনো নাম হয়? মানুষ খামোখাই চেষ্টা করে এই সব নাম দিয়ে ব্যাপারটাকে বোঝবার। কোনো শিল্পী কি আঁকতে পারেন এই রঙ? রাশেদের বিশ্বাস হয় না!
‘আহা, এই সময় রূপা থাকলে বড় ভালো হতো’—রাশেদ মনে মনে ভাবে। এই পদ্মার পাড়, এই ভরা যৌবনবতী উন্মত্ত নদী, এই কনে দেখা আলো— সব কিছুর ভেতরে রূপা, তার সারা জীবনে দেখা সবচেয়ে আকর্ষণীয় মেয়েটি, যদি থাকত!
ছয়
বুঝতেই পারছেন, এতক্ষণ যা বলেছি, সেগুলো পুরোপুরিই রাশেদের অবাধ-অবারিত কল্পনার ফসল। প্রকৃত ব্যাপারটা ছিল ঠিক এর উল্টো। শুনবেন? ঠিক আছে, বলছি।
রূপার বিরামহীন আড্ডায় রাশেদ বিষণ্ন হয়ে উঠত কখনো কখনো, কিন্তু সব সময় সেটা বুঝতে দিত না। এমনকি তার কাছে সময় চাইলে নানা কৌশলে এড়িয়ে যেত মেয়েটি। রূপাকে চোখ ভরে দেখার সাধ অপূর্ণই থেকে যেত রাশেদের। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
রাশেদ অনেক দিন ধরেই বলছিল, চল, একদিন ঢাকার বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
কোথায় যাবে?
তুমি যেখানে যেতে চাও।
তুমিই বল না, কোথায় যাবে!
কাছাকাছি কোথাও। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরে আসা যাবে—এ রকম।
ঠিক আছে, চল। কবে যাবে?
তুমি কবে পারবে?
ছুটির দিন ছাড়া তো পারব না।
সেটা তো আমিও পারব না।
তাহলে আগামী শুক্রবার?
আচ্ছা, ঠিক আছে।
রাশেদ ভীষণ খুশি হয়ে ওঠে। পুরো একটা দিন রূপাকে কাছে পাওয়া আর চোখ ভরে দেখার সুযোগ, আহা, এই আনন্দ সে কোথায় রাখে! শুক্রবারের অপেক্ষায় সে প্রায় বুঁদ হয়ে থাকে। যেন কী এক অদ্ভুত নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে। কল্পনার বহুবর্ণিল ঘুড়ি ওড়ে আকাশজুড়ে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দিনটি আসার আগেই সব স্বপ্ন-কল্পনার অবসান ঘটে। রূপা জানায়—
এই শুক্রবার যে একটু আটকে গেলাম, পরের সপ্তাহে যাই?
কেন, কোনো সমস্যা?
না, ঠিক সমস্যা না…
কোনো কাজে আটকে গেছ?
হুম।
কী কাজ? আমাকে বলা যায়?
বলা যাবে না কেন?—বলবে কি না; বললে কী প্রতিক্রিয়া হবে, ভাবতে ভাবতেই রূপা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে—বলে ফেলাই ভালো। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত গোপন থাকবে না এবং রাশেদ জেনেই ফেলবে। এখন গোপন করলে বরং খারাপ প্রতিক্রিয়া হবে পরে। অতঃপর সে জানায়—
সত্যি করে বলি, তোমার সাথে যে শুক্রবার বেড়াতে যাবার কথা, আমি সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমিও এ নিয়ে কথা বলনি, আমিও…
তাতে কী?—রাশেদ সহজভাবেই নেয়—শুক্রবার তো আর চলে যায়নি, আরও দু-দিন বাকি আছে।
কিন্তু আমি যে অন্য একটা কাজে…
ও হ্যাঁ, তুমি কী যেন একটা কাজে আটকে গেছ, বলছিলে। কী কাজ?
ওই দিন মামুনের বার্থডে তো, আমি একটা পার্টি দিচ্ছি।
ও!
সবাইকে বলার পর হঠাত্ মনে পড়েছে, ওই দিন আমাদের বেড়াতে যাবার কথা! সবাইকে বলে ফেলেছি যে, এ জন্য ক্যান্সেলও করতে পারছি না! আর তা ছাড়া বার্থডে তো আরেক দিন সেলিব্রেট করা যায় না!
তা তো বটেই!
রাগ করলে?
নাহ!—মুখে ‘না’ বললেও রাশেদের কষ্ট হচ্ছিল। মনে একবার এ-ও উঁকি দিয়েছিল, এই কিছু দিন আগেই তার জন্মদিন ছিল। রূপা ছোট্ট করে একবার শুভেচ্ছা জানিয়েছে মাত্র, তা-ও মেসেজ পাঠিয়ে। পার্টি দেওয়া দূরের কথা, দেখা করার কথাও বলেনি। এমনকি একবার ফোন করে জিজ্ঞেসও করেনি—কেমন কাটল তার জন্মদিন! অবশ্য জন্মদিন ব্যাপারটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণও নয়। সে প্রায় অনুভূতিশূন্যই থাকে ওই দিন। আমিও একটা মানুষ, তার আবার জন্মদিন—এক সময় এই রকম ভাবনায় কাতর হতো বলে এখন জন্মদিনের কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করে সে এবং যথাসম্ভব সাধারণভাবেই কাটায় দিনটি। ওই দিন রূপার কাছ থেকে কোনো ফোন না পেয়ে বা রূপার দেখা না পেয়ে তাই তার খারাপ লাগেনি। কিন্তু এখন লাগছে। মামুনের জন্য তুমি আমার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল করে পার্টির আয়োজন করতে পার, আর আমাকে একবার হ্যালোও বলতে পার না! আর তা ছাড়া এই এতগুলো দিন পার হলো, অথচ একদিনের জন্যও তোমাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পেলাম না আমি। প্রতিদিনই তুমি ওই নক্ষত্র-পুরুষের সাথে কাটাও, আমার জন্য মাত্র একটা দিন বরাদ্দ করতে পারলে না! এ পর্যন্ত কবার দেখা হয়েছে তোমার-আমার, আর তোমার-মামুনের? কখনো কি তুলনা করে দেখেছ? অনুপাতটা যদি এক বনাম একশ হয়, তাহলে এটাকে তুমি কীভাবে জাস্টিফাই করবে?
অ্যাই, কী হলো তোমার?—রূপার ডাকে তার ভাবনার সুতো কেটে যায়।
না, কিছু না।
মন খারাপ করেছ?
নাহ।
আমার মনে হচ্ছে, রাগ করেছ!
নাহ!
রাগ কর না, প্লিজ। শুক্রবার তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। এই শুক্রবার হলো না, পরের সপ্তাহে যাব।
হুম, ঠিক আছে।
বল, রাগ করনি!
না, করিনি।
একটু হাস তাহলে।
ফোনের ওপাশে রাশেদ মৃদু-ম্লান হাসে। হাসিটাকে কান্নার মতো দেখায়, যদিও রূপা সেটি দেখতে পায় না।
শুক্রবার মামুনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা খ্যাতিমান রেস্টুরেন্টে বন্ধুদের নিয়ে পার্টির আয়োজন করে রূপা। ছুটির দিন ছিল বলে সারা দিন একসঙ্গে কাটাবার পরিকল্পনাও করে সবাই মিলে। বেশ সেজেগুঁজে, নিজেকে রূপকে আরও আকর্ষণীয়রূপে সাজিয়ে সে হাজির হয় পার্টিতে। রাশেদকে জানিয়ে গিয়েছিল বলে রূপা নিশ্চিত ছিল, বন্ধুদের সামনে মেসেজ পাঠিয়ে বা ফোন করে হঠাত্ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে না সে। আড্ডা জমে উঠতে সময় লাগে না। কেক কাটার সময় মামুন বেঁকে বসে—‘আমি একা কাটব না, হোস্টকেও আসতে হবে!’ বন্ধুদের হুল্লোড়ে রূপাকেও যেতে হয, আর দুজন হাতে হাত রেখে কেক কাটে। এক টুকরো কেক নিয়ে মামুনকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয় রূপা, নক্ষত্র অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটুকু তুলে দেয় রূপার মুখে। কেক-পর্ব শেষে এক বন্ধু হয়তো উস্কে দেওয়ার জন্যই বলে—
দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য দুজনের একটা নাচ হয়ে যাক!
হবে নাকি?—মামুন জিজ্ঞেস করে।
না, হবে না!—রূপা কপট রাগ দেখায়।
কেন, কেন? সমস্যা কী? হোক না রূপা। তোমার তো নাচেরই ফিগার, হয়ে যাক একটা।—উস্কানিদাতা বন্ধুটি বলে।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া নাচা যায় নাকি? এইখানে মিউজিক সিস্টেম কোথায়?—রূপা এড়াবার জন্য বলে।
এটা কোনো ব্যাপার হলো? আমার মোবাইলের মেমোরি কার্ডে যে পরিমাণ মিউজিক আছে, সারা জীবন নাচলেও তা শেষ হবে না। কোন ধরনের মিউজিক চাও, বল? বাংলা সিনেমার গান? হিন্দি সিনেমার গান? ক্লাসিকাল মিউজিক? নাকি ব্যালে ড্যান্সের মিউজিক?
ব্যালে ব্যালে—সমস্বরে ধ্বণিত হয় ব্যালের পক্ষে ভোট।
ঠিক আছে। সেটাই দিচ্ছি।
রূপার আর না করার উপায় থাকে না। দুজনে মিলে উঠে দাঁড়ায়। মামুন এক হাতে পেঁচিয়ে ধরে রূপার কোমর, অন্য হাতে তুলে নেয় রূপার এক হাত, রূপা তার অন্য হাতটি রাখে মামুনের কাঁধে। ব্যালে ড্যান্সের যা নিয়ম আর কি! মিউজিক শুরু হয়, শুরু হয় তাদের নাচও। সময় ভুলে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে তারা নেচে যায়। দুজনের চোখ পরস্পরের প্রতি নিবদ্ধ, ফিসফিস আলাপ—দুজন ছাড়া যা কেউ শুনছে না, আর মিউজিকের তালে তালে নেচে চলা। যেন সমস্ত পৃথিবী বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাদের সামনে থেকে। একজনের সামনে আরেক জন ছাড়া আর কেউ নেই, আর কিছু নেই। এক সময় ক্লান্ত হয়েই হয়তো, এ ছাড়া আর কী-ই বা কারণ থাকতে পারে, রূপা মাথা এলিয়ে দেয় মামুনের কাঁধে, মামুন আরও নিবিড় করে তাকে জড়িয়ে ধরে, আর আবেশে রূপার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কখন নাচ থেমে গিয়েছিল, বুঝতে পারেনি দুজনের কেউই। সম্মিলিত হাততালিতে ঘোর ভাঙে দুজনের। লাজুক হেসে বন্ধুদের দিকে ঘুরে বো করে দুজন।
এরপর শুরু হয় ভোজনপর্ব। রূপা পাশে বসে যত্ন আর মমতা নিয়ে মামুনকে খাওয়ায়। তার বড় ভালো লাগে, মুহূর্তগুলোকে স্বপ্নের মতো মনে হয়। আহা, এই স্বপ্নটা যদি চিরস্থায়ী হতো! কিন্তু পার্টি যখন জমে উঠেছে, তখনই রূপার মোবাইলে মেসেজ টোন বেজে ওঠে, দ্যাখে—রাশেদের মেসেজ। একটু চমকায় সে, কারণ এতক্ষণ সে ভুলেই ছিল আটপৌরে লোকটার কথা। যেন অনেক চিন্তা করতে হয়েছে লিখতে গিয়ে, এমনই এক দ্বিধান্বিত স্বর আবিষ্কার করল সে মেসেজটি পড়ে—‘বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দাও, এ নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। আমি চাই না, আমার জন্য তোমার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হোক। কিন্তু এই যে ছুটির দিনগুলোতেও তুমি বাসায় থাক না, তোমার ছোট্ট খোকাটা তার মাকে একেবারেই কাছে পায় না, এসব ভেবে তোমার খারাপ লাগে না? ওরও তো অধিকার আছে তোমাকে কাছে পাওয়ার, না?’ রূপা প্রায় চমকে উঠেছিল এই মেসেজ পড়ে। এই এতকাল ধরে সে এই বন্ধুদের সঙ্গে মিশে আছে, কেউ তো কখনো তাকে এই কথা বলেনি! যে নক্ষত্র-পুরুষের জন্য তার হূদয় উজাড় করা প্রেম, যার সঙ্গে এত দিন ধরে সে এ করকম লীন হয়ে আছে, সে-ও তো কখনো জিজ্ঞেস করেনি খোকার কথা! অথচ, এই অল্প কদিনের সম্পর্ক, এর ভেতরেই রাশেদ বিষযটি নিযে ভেবে ফেলেছে! নিজের জন্য নয়, সে সময় চাইছে খোকার জন্য! তার খোকা! হঠাত্ করেই যেন তার মা-হূদয় কেঁদে ওঠে, খোকাকে বুকে জড়িয়ে ধরবার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, অথচ তখন আড্ডাটা মধ্যগগনে, চলছে ইরোটিক আলোচনা, মেয়েদের শরীর যেখানে প্রধান বিষয়বস্তু। রূপাও এতক্ষণ ধরে অংশ নিচ্ছিল সমানতালে, কিন্তু হঠাত্ যেন সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার অনুভূতি তাকে পেয়ে বসে! এখান থেকে দ্রুত চলে যেতে ইচ্ছে করলেও সে অবশ্য তা পেরে ওঠে না, মামুন হঠাত্ তার হাত ধরে বসে। একটু আগেই যে এতক্ষণ ধরে সংলগ্ন হয়ে ছিল তারা, তাতেও যেন সাধ মেটেনি তার। হাত ধরা অবশ্য নতুন কিছু নয়, সবার সামনে দুষ্টুমির ছলেই সে অনেকবার করেছে এমন কাজ, এবারও তা-ই করে এবং সিনেমার স্টাইলে বলে—
সুন্দরী, শুধু একবার বল, তুমি আমার!
হাসির হুল্লোড় ওঠে, রূপাও সব ভুলে হেসে ওঠে, কপট রাগ দেখিয়ে বলে—ছেড়ে দে, ছেড়ে দে আমাকে শয়তান!
না, সুন্দরী, তুমি না বলা পর্যন্ত ছাড়ব না।
শয়তান! তুই আমার দেহ পাবি, কিন্তু মন পাবি না!
আমি তো দেহই চাই সুন্দরী, মন বেঁচে তুমি চটপটি খেয়ো, আমাকে ওই সেক্সি দেহটা দাও…
বন্ধুরা হেসে লুটোপুটি খায়। দুষ্টুমির এই পর্ব শেষ হলেও নক্ষত্র রূপার হাত ছাড়ে না। রূপা ফিসফিসিয়ে বলে—হাত ছাড়, সবাই কী ভাবছে!
যা ভাবার ভাবুক। আমি ছাড়ার জন্য তোমার হাত ধরিনি।
কী শুরু করলে! ধুর!
তুমি শুধু একবার বল, আমাকে ভালোবাস!
সেটা কি সবার সামনে বলতে হবে! প্রেম কি বাজারি বিষয়?
গোপনে বলবে? তাহলে চল, দুজনে মিলে কোথাও যাই। আমি তো তোমাকে চাই, গোপনে-নির্জনে-একান্তে চাই…
তুমি থামবে? কেউ শুনে ফেললে…
শুনবে না। তুমি বল। যাবে আমার সাথে? দূরে কোথাও? একান্তে, নির্জনে…
আচ্ছা, যাব। এখন হাত ছাড়।
সত্যি যাবে?
রূপা মৃদু-লাজুক হাসে—হুঁ, সত্যি যাব।
কবে যাবে?—নক্ষত্র যেন চাঁদ হাতে পেয়েছে এমনই বিস্মিত কণ্ঠে বলে।
তুমি যেদিন নিয়ে যাবে, সেদিনই যাব…
অ্যাই, কী হচ্ছে ওখানে?—একজন হাঁক দেয়— আড্ডায় এসে ফিসফিস করে প্রেম করা চলবে না।
আবার হাসির হুল্লোড়, রূপা আলগোছে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় বটে, কিন্তু তার বুক জুড়ে কোমল এক আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। আহা, সত্যিই যদি এই লোকটার সঙ্গে প্রেমটা হয়ে উঠত!
মুহূর্তে মুহূর্তে রঙ পাল্টানো মন নিয়ে বড় বিপদে ছিল রূপা। বিপদ আরেকটাও ছিল। প্রায় সবাই মামুন আর রূপার সম্পর্ককে প্রেম বলেই জানত এবং সেভাবেই গণ্য করত। এই যেমন আজকের ঘটনাগুলো। দুজনের হাতে হাত রেখে কেক কাটা, পরস্পরকে মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া, তারপর পরস্পরকে জড়িয়ে নাচ, কিংবা পাশে বসে যত্ন করে মামুনের খাবারের তত্ত্বাবধান—এগুলো তো খুব স্বাভাবিক বিষয় নয়! কেবল বন্ধুত্ব হলে কি আচরণগুলো এ রকম হতো? সম্পর্কটি প্রেমের, এটা ধরে নিয়েছে বলেই বন্ধুরা এগুলো অনুমোদন করে। শুধু কি আজকের ঘটনা? তারা যখন দল বেঁধে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যায়, রূপা আর মামুন সব সময়ই পাশাপাশি বসে—এটা অলিখিত নিয়ম। এর ব্যতিক্রম ঘটেনি কখনো। আবার, আড্ডাটা যখন কোনো বন্ধুর বাসায় হয়, তারা দুজনকেই সুযোগ করে দেয় একটু একান্তে সময় কাটাবার। এক বন্ধুর বাসায় একই বিছানায় শুয়ে দুজনকে গল্প করতে কি দেখেনি তারা? হয়তো এত লোকের ভেতরে এই শয়নও নির্দোষই থাকে, শরীর পর্যন্ত এগোয় না, কিন্তু তারা মোটামুটি নিশ্চিত যে, মামুন ইতিমধ্যেই রূপাকে বিদ্ধ-রক্তাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে! অনুমোদন তারা করে বটে কিন্তু ঈর্ষাও হয় কারও কারও, এত সুন্দরী একটা মেয়েকে মামুন একলা পেল! এই ঈর্ষাকাতররা সুযোগ বুঝে কথাটা বলতেও ছাড়ে না। আর সেসব কথা মুখে মুখে ছড়াতে ছড়াতে এক সময় ভার্চুয়াল জগতে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি আলোচনার মুখরোচক উপাদানে পরিণত হয়। রূপাকে পছন্দ করত অনেকেই, আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে—রূপার প্রতি লোভ ছিল আরও অনেকের, কিন্তু মামুনের কারণে সেটা প্রকাশ করতে পারত না কেউ। হয়তো সে জন্যই তাদের সম্পর্কটিকে নিয়ে অনেক ইরোটিক কথাবার্তাও ছড়িয়ে পড়েছিল। রূপা বা মামুন কেউই অবশ্য সেটা খুব একটা পাত্তা দিত না বিষয়টিকে। এত কথা ছড়াচ্ছে, তবু, রূপা অবিরামভাবে, ব্লগে ও ফেসবুকে, এবং বন্ধুদের আড্ডায় প্রকাশ্যেই মামুনের প্রতি তার তীব্র ভালোলাগা প্রকাশ করত। এমনকি রাশেদের সঙ্গে সম্পর্কিত হবার পরও সেই প্রকাশের কোনো ঘাটতি হয়নি কখনো।
সাত
আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে—রাশেদ এগুলো মেনে নিত কেন? সত্যি বলতে কি, অনেক দিন পর্যন্ত রাশেদ এগুলো নিয়ে কোনো কথাই বলেনি। তাদের আড্ডা, কিংবা ছুটির দিনে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়া, অথবা মামুনের জন্য নিজের ইমেজ পর্যন্ত ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়ার মতো কাজকর্ম করা—সব দেখেও সে চুপচাপই ছিল। তার ধারণা ছিল, একটি প্রেমময় সম্পর্ক এই বিতিকিচ্ছিরি জীবন-যাপন থেকে রূপাকে রক্ষা করবে। কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন তার চোখে পড়ল না, শুধু একটি ছাড়া। রূপা এখন তার খোকাকে একটু সময় দেওয়া শুরু করেছে। রাশেদ তাতেই খুশি ছিল। মানুষের অভ্যাস-পরিবর্তন একদিনে ঘটে না, সময় লাগে, সে জানত। সে তাই রূপাকে সময় দিতে চাইছিল। কিন্তু মামুনের প্রতি তার আকর্ষণ কমে না কেন? তবে কি রূপা ওই প্রেম থেকে বেরোতে পারেনি? ধীরে ধীরে তার ঈর্ষাবোধ তৈরি হতে লাগল, আর এ নিয়ে রূপাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল। রূপা খুব বিব্রত আর বিরক্ত হতো এসব প্রশ্ন শুনলে। কৌশলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করত অথবা মিথ্যে উত্তর দিত। খুব কষ্ট পেত রাশেদ। যে বিষয়গুলো সে জানে, সেগুলো নিয়েও রূপার এই অবলীলায় মিথ্যে বলার কারণ কী? সে কি তবে মামুনের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি তার কাছে লুকোতে চায়? হ্যাঁ, তার সেটাই মনে হলো কিছু দিন পর। কারণ, এসব প্রশ্ন তোলার পর থেকে মামুনের সঙ্গে তার আড্ডা আর কথাবার্তার পুরো বিষয়টি চেপে যেতে লাগল রূপা। এমনও হতে লাগল—হয়তো, রাশেদের সঙ্গে আগে থেকে ঠিক করে রাখা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আগের দিন হঠাত্ করেই বাতিল করে দিত রূপা নানা অজুহাতে, আর পরে সে জানতে পারত—ওই দিন আসলে মামুনের সঙ্গেই ছিল রূপা। সে এ-সবের কারণ খুঁজে পেত না। তার চেয়েও মামুন কি বেশি গুরুত্বপূর্ণ রূপার কাছে? সে আরও ঈর্ষাপ্রবণ হয়ে উঠত, আর রেগে গিয়ে রূপাকে নানা কথা শোনাত। একবার তো শর্তই দিয়ে বসল, মামুনের ফেসবুকের কোনো স্ট্যাটাসে লাইক বা কমেন্ট দেওয়া যাবে না—ইত্যাদি! রূপা অবশ্য এসব শর্ত থোড়াই কেয়ার করত। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে রাশেদের। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন, ভার্চুয়াল জগতেও সে খুব নিঃসঙ্গ মানুষ। কারও সঙ্গেই খুব বেশি হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তার। এ নিয়ে অবশ্য তেমন কোনো দুঃখবোধও নেই রাশেদের। সে তার মতো করে আছে, কে কী করল তাতে তার কিছু যায়-আসে না। এ রকম নির্বিরোধ থেকেও যে সে কারও রোষের স্বীকার হতে পারে, রাশেদ তা কল্পনাও করেনি। অথচ ঘটে তেমনই, এবং ঘটায় মামুন! রূপার বন্ধুবৃত্তের সঙ্গে সে কখনো বিরোধে জড়ায়নি, কারও সম্বন্ধে কখনো কটূ মন্তব্য করেনি, অথচ তাদেরই কয়েক জন একযোগে আক্রমণ করে বসে তাকে। তার ফেসবুক আর ইমেইলের ইনবক্স ভরে ওঠে তাদের আক্রমণাত্মক কথাবার্তায়। এই সম্মিলিত আকস্মিক আক্রমণে সে হতভম্ব হয়ে যায়, কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। সে একা মানুষ, তা-ও চুপচাপ, নির্বিষ। এ রকম বিষাক্ত ছোবল সে ঠেকাবে কীভাবে? এরা সবাই রূপার বন্ধু, সে কি জানে এই ঘটনা? জানলে ঘটতে দিচ্ছে কেন, কেন তাকে ওদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করছে না, কেন এ রকম চুপ করে থাকছে? এদের ভেতরেই একজন জানিয়েছে, রূপাই নাকি ওদের কাছে রাশেদের নামে অভিযোগ করেছে! বলেছে—সে নাকি তাদের নামে নানা কুত্সা রটায়, রূপাকে যন্ত্রণা দেয়, সে ফেসবুকে আছে বলে রূপা মামুনের কোনো স্ট্যাটাসে মন্তব্য করতে অস্বস্তি বোধ করে—ইত্যাদি। আর এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতেই নাকি তাকে ট্রিট দেওয়া হচ্ছে মামুনের নেতৃত্বে! এ-ও কি সম্ভব? বিশ্বাসযোগ্য? রূপা কি তার নামে অভিযোগ করতে পারে? তাদের ভেতরকার যা কিছু দ্বন্দ্ব সেগুলো তো একান্তই প্রেমময় সম্পর্কের কারণে তৈরি। মামুনের স্ট্যাটাসে মন্তব্য করার ব্যাপারে তার যে আপত্তি, সেটাও তো প্রেমজনিত ঈর্ষাবোধ থেকে উদ্ভূত! এগুলো কি রূপা বোঝে না? এসব নিয়ে কি সে মামুনের কাছে অভিযোগ করতে পারে? নাকি আদৌ কিছু জানে না সে? তার নামে যা কিছু বলা হচ্ছে, সবই মিথ্যে? সে রকমই মনে হলো রাশেদের। ব্যাপারটা জানানো দরকার ভেবেই রূপাকে মেসেজ করে বিস্তারিত জানাল সে। কিন্তু রূপা এগুলোর কিছুই বিশ্বাস করল না, এমনকি সে মেইলগুলো ফরোয়ার্ড করতে চাইলে রূপা সেগুলো দেখতেও রাজি হলো না। সে অসহায় বোধ করছিল, কেন তার কথা বিশ্বাস করছে না রূপা, জানতে চেয়ে বারবার মেসেজ পাঠাচ্ছিল। রূপার তরফ থেকে যখন-তখন ফোন করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল বলে ফোনও করতে পারছিল না, ফলে বারবার মেসেজ পাঠিয়ে একবার কথা বলার কাতর মিনতি জানাচ্ছিল। রূপা কোনোভাবেই এই মিনতিতে সাড়া দিচ্ছিল না, সব মেসেজের উত্তরও দিচ্ছিল না, তার এই নীরবতায় আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল রাশেদ। এক নাগাড়ে সে অনুরোধ করে যাচ্ছিল কথা বলার জন্য, আর রূপা—‘তুমি রেগে আছ, আগে মাথা ঠান্ডা কর, তারপর কথা বলব’—বলে চুপ করে যাচ্ছিল! এক নাগাড়ে তিন দিন চলল এই ঘটনা। রাশেদ তার ফেসবুক ডিঅ্যাকটিভেট করে দিল, আর খেয়াল করল—একই সময়ে একসঙ্গে একাধিক স্ট্যাটাস দিচ্ছে, রূপা তার প্রত্যেকটিতে গিয়ে মজার মজার মন্তব্য করছে আর মামুনের স্ট্যাটাসে গিয়ে বলছে তার প্রেমময় মুগ্ধতার কথা। তুমুল আড্ডায় মেতে উঠেছে সে বন্ধুদের সঙ্গে, যেন রাশেদকে তাড়াতে পেরে সে নিজেও দারুণ আনন্দিত। এক দিকে তার সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি, অন্যদিকে তার আপত্তি উপেক্ষা করে মামুনের সঙ্গে তুমুল প্রেমময় আড্ডা—সে যা বোঝার বুঝে যায়। সব কিছু ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে, রূপাকে জানায়ও সে কথা, কিন্তু রূপা ভ্রূক্ষেপহীনই রয়ে যায়!
ওর মনটা খুব ছোট, বুঝলেন? খুবই সংকীর্ণ মনের মানুষ ও— রূপা আমাকে বলেছিল।
কেন বলছ এ কথা?
বলব না কেন? আমি কোথায় কাকে লাইক দেব, কার স্ট্যাটাসে কমেন্ট করব না-করব, সেটা ও ঠিক করে দেওয়ার কে?
রাশেদ কি সবার ব্যাপারেই আপত্তি করত?
না, তা করত না। তবে মামুনের ব্যাপারেই বা ওর এত আপত্তি কেন?
সে তো তোমাকে ভালোবাসে। মামুনের ব্যাপারে তোমার এই আগ্রহ হয়তো তাকে ঈর্ষাকাতর করে তুলত।
হতে পারে। কিন্তু এগুলোকে তো প্রশ্রয় দেওয়া চলে না।
কী করতে তুমি?
পাত্তা দিতাম না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কথা বন্ধ করে দিতাম।
কথা বন্ধ?
হ্যাঁ, এটা ছিল তার জন্য আমার তরফ থেকে শাস্তি। কথা বন্ধ করলে ও খুব মুষড়ে পড়ত।
একটু নিষ্ঠুর হয়ে গেল না ব্যাপারটা?
হলে হয়েছে। এ রকম প্রেমিকের জন্য একটু নিষ্ঠুর হতে হয়।
তুমি যে কথা বন্ধ করে দাও, সে যদি নীরব হয়ে যায় কখনো?
হবে না, হবে না। ও কখনোই তা হতে পারবে না।
এত নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?
ওকে আমি চিনি তো! একেবারে নির্লজ্জ একটা মানুষ ও।
নির্লজ্জ বলছ?
হ্যাঁ, বলছি। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন।
কী উদাহরণ?
ফেসবুকে আমি ওকে লিমিটেড প্রোফাইলে রেখেছি…
এটা আবার কী জিনিস?
ও! আপনি তো আবার এসব বোঝেন না! মুশকিল! লিমিটেড বা রেস্ট্রিকটেড রাখার মানে হলো, ও আমার সব অ্যাকটিভিটি দেখতে পাবে না। কাউকে লাইক দিলে বা কারও স্ট্যাটাসে কমেন্ট করলে ওর হোমপেজে সেটা আসবে না। এমনকি আমার ফ্রেন্ডলিস্টে যারা আছে, তাদের সবাইকে সে দেখতে পাবে না। শুধু ওর আর আমার কমন ফ্রেন্ডদের দেখতে পাবে।
সব না বুঝলেও রেস্ট্রিকশনের ব্যাপারটা বুঝতে পারছি।
ওটুকু বুঝলেই চলবে। তো, ও ব্যাপারটা টের পেয়ে ঘ্যানঘ্যান শুরু করল। কেন ওকে আমি রেস্ট্রিকটেড করে রেখেছি, কেন ওপেন করে দিচ্ছি না—ইত্যাদি। ভেবে দেখুন, ওকে আমি আমার সব কিছু দেখার পারমিশন দিচ্ছি না, এটা টের পেয়ে তো ওর লজ্জা পাওয়ার কথা, অপমানিত হওয়ার কথা। উল্টো নির্লজ্জের মতো…
হুম। বুঝতে পারছি। একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
হ্যাঁ, করুন না! আমি তো আপনার কাছে কিছু লুকোচ্ছি না।
তুমি কি সত্যিই ওই আটপৌরে লোকটাকে ভালোবেসেছ?
তা বেসেছি।
এত বিরক্তি নিয়ে ভালোবাসা যায়?
বিরক্তি তো ওর কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য।
বিশেষ করে মামুনের ব্যাপারে ওর আপত্তির জন্য, তাই না?
হ্যাঁ, সেটাই প্রধান কারণ। কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। রাশেদ আসলে কোনো ছেলের সঙ্গেই আমার অন্তরঙ্গতা মেনে নিতে পারে না। বললাম না, সংকীর্ণ মন ওর!
তাহলে সম্পর্কটা ধরে রেখেছ কেন?
মায়া লাগে যে!
মায়া লাগে?
হ্যাঁ, খুব মায়া লাগে।
এত সংকীর্ণমনা, আনস্মার্ট, আটপৌরে একটা লোকের জন্য তোমার মায়া লাগে?
লাগে তো! মাঝে মাঝে অবশ্য খুব বিরক্ত হই…
কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে, এই রকম একজন লোকের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা ঠিক মানায় না! তার পরও রেখেছ কেন, সত্যি করে বল তো!
তো কী করব?
ভেঙে ফেল।
এসব কী বলেন? সম্পর্ক কি মুখের কথা? চাইলেই ভাঙা যায়?
না, মুখের কথা নয়। তবে চিরস্থায়ী কোনো ব্যাপারও নয়। আকস্মিক আবেগেও কোনো কোনো সম্পর্কের সূত্রপাত হতে পারে, পরে যুক্তি-বুদ্ধির বিচারে যেটাকে ভুল হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। এ ধরনের সম্পর্ক থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।
আপনি ভুল বুঝেছেন। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটি ভুল নয়!
কিন্তু তোমার কথাবার্তা থেকে সে রকমই মনে হয়।
এটা আপনার ভুল ইন্টারপ্রিটেশন।
কেন?
শুনুন, ওর অনেক ত্রুটি আছে, সত্যিই ও খুব সাধারণ আর আটপৌরে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর একটা বিরাট গুণ আছে।
কী সেটা?
সমর্পণ!
মানে?
মানে আর কী! ওর সমর্পণটা নিখাদ, নির্ভেজাল। আমূল সমর্পণ বলতে যা বোঝায়, ওরটা তাই। মানুষ বোধ হয় ঈশ্বরের কাছেও এতটা সমর্পিত হয় না, যতটা ও আমার কাছে…
আচ্ছা!
হ্যাঁ, সত্যিই। আর ওর প্রেমটা এত আবেগপূর্ণ, এত তীব্র, এত গভীর যে এটাকে বর্ণনা করার উপায় নেই। ও আমাকে এত ভালোবাসে, এত ভালোবাসে…
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না রূপা, গলা বুঁজে এল তার! আর আমি অবাক হয়ে ভাবলাম— অদ্ভুত একটা মেয়ে এই রূপা। একটু আগেই ঝাঁজালো কণ্ঠ থেকে যার প্রতি ঝরে পড়েছে প্রায় ঘৃণামিশ্রিত বিরক্তি, এখন তার জন্যই আবেগে রুদ্ধ হয়ে এসেছে কণ্ঠ! একটু বিরতি নিয়ে সামলে উঠে মৃদু হাসল রূপা, বলল—
এমন প্রেম আমি জীবনে আর কখনো পাইনি। ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম আমি, সেই কিশোরী থাকতেই প্রেমে পড়েছিলাম, অথচ সেই প্রেমও এত তীব্র ছিল না। একজন মানুষ যে রকম ভালোবাসা পাওয়ার স্বপ্ন দেখে কিন্তু কোনো দিনই সেই স্বপ্ন পূরণ হয় না, আমি রাশেদের কাছ থেকে সে রকম প্রেম পেয়েছি।
এই প্রেম কি একতরফা?
মানে?
মানে, কেবল সে-ই ভালোবেসেছে তোমাকে, তুমি বাসনি?
বাসি তো। খুব ভালোবাসি। যখন ওর কথা ভাবি, তখন আমার জগতে আর কেউ থাকে না। কিন্তু আপনার এ রকম মনে হলো কেন?
আমার কিছু মনে হয়নি, জানার জন্য জিজ্ঞেস করলাম।
কিছু একটা তো মনে হয়েছেই, নইলে কি আর এই কথাটা জিজ্ঞেস করতেন? কেন মনে হলো, বলুন না, প্লিজ!
তুমি বাদলকে ভালোবাস?
কাকে?—রূপা চমকে উঠল, যেন স্বামীর নামটি কোনোভাবেই এখানে আসার কথা নয়।
বাদলকে?
হ্যাঁ, বাসি তো। বাদলই আমার প্রথম প্রেম। ও যদি বদলে না যেত, যদি এত ব্যস্ত না হয়ে পড়ত, তাহলে হয়তো আমার জীবনে দ্বিতীয় কোনো প্রেম আসত না।
আচ্ছা, বুঝলাম। মামুনকে ভালোবাস?
রূপা চুপ করে রইল।
বাস?—আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।
জানি না।—আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনির্দিষ্টভাবে উত্তর দিল রূপা।
জান না, নাকি নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাও না?
এবারও একটু সময় নিল রূপা, তারপর বলল—একসাথে দুজন মানুষকে কি ভালোবাসা যায়?
প্রায় স্বগতোক্তির মতো শোনাল তার কথাটা। যেন আমার প্রশ্নের উত্তর নয় বরং নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলছে সে। তবু, কথা চালিয়ে নেবার জন্যই আমি বললাম—সেটা তো তোমারই ভালো জানবার কথা!
আপনার কী মনে হয়?
আমার কিছু মনে হয় না।
এর মানে কী? আপনার কিছু মনে হয় না কেন?
এ ব্যাপারে আমার কোনো মতামত নেই।
আমি তো শুধু নিজের কথা বলিনি, ইন জেনারেল প্রশ্ন করেছি। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
এ ব্যাপারে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে ইন জেনারেল হলে একটা মতামত দেওয়া যায়।
সেটাই দিন।
একসাথে দুজন কেন, তারচেয়ে বেশি মানুষকে ভালোবাসা যায়। যেমন তুমি বাদলকে ভালোবাস, আবার একইসঙ্গে রাশেদকে ভালোবাস। তবে একসাথে দুটো প্রেমের সম্পর্ক কন্টিনিউ করা কঠিন। যেকোনো একটিতে ঘাটতি পড়বেই।
ঘাটতি?
হ্যাঁ।
কেন? যদি দুজনকে ভালোবাসা যায়, তাহলে সম্পর্ক রাখতে গেলে একটাতে ঘাটতি পড়বে কেন?
প্রেম চায় অখণ্ড মনোযোগ। দুটো সম্পর্ক থাকলে মনোযোগটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়।
হুম!
তোমার ক্ষেত্রে কি সেটা হয়েছে?
রূপা চুপ করে রইল। কিন্তু আমার কৌতূহল এত সহজে দমবার নয়। কথাটা আবার জিজ্ঞেস করলাম। ও সরাসরি উত্তর না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করল—
আপনার কী মনে হয়?
আমার মনে হওয়াটা তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার হয়েছে কি না, সেটা তুমিই ভালো বলতে পারবে।
ভেবে দেখিনি কখনো। আপনার প্রশ্ন শুনে ভেবেও বুঝতে পারলাম না।
তার মানে, তুমি ঠিক নিশ্চিত নও যে, রাশেদের প্রতি তোমার মনোযোগ অখণ্ড কি না, যদিও তাকে তুমি ভালোবাস!
এ রকম একটা সিদ্ধান্তমূলক জায়গায় যেতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
এই বিষয়ে সিদ্ধান্তহীন থাকতে চাও?
ঠিক তা-ও না! আমি আসলে ব্যাখ্যা করতে পারছি না…
মামুনের বিষয়টা?
হ্যাঁ।
সমস্যাটা কোথায়?
সেটাও বুঝি না। মামুনকে আমি পছন্দ করি, খুবই পছন্দ করি, সন্দেহ নেই। তার সঙ্গে আমার প্রেমও হতে পারত। সে রকম সমস্ত সম্ভাবনাই বিদ্যমান ছিল। একটা চমত্কার বন্ধুত্ব ছিল, প্রতিদিন নানা ফর্মে কথা হতো। ফোনে, চ্যাটরুমে, ফেসবুকে, নিদেনপক্ষে এসএমএস করে। দেখাও হতো নিয়মিতই। তার সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে আমার, তার একশ ভাগের এক ভাগও রাশেদের সঙ্গে হয়নি। কতবার যে মামুনের সঙ্গে বাইরে গিয়েছি, কতবার পাশাপাশি হেঁটেছি, কত অজস্রবার তার স্তুতি শুনেছি—এসবের কোনো কিছুই রাশেদের সঙ্গে হয়নি কখনো। বলতে গেলে, রাশেদের সঙ্গে আসলে আমার কিছুই হয়নি। এখনো মামুন ডাকলে আমার মন উতলা হয়ে যায়, রাশেদের কথা আমার মনেও থাকে না। ছুটে যাই তার কাছে। এমনকি রাশেদের সঙ্গে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে সেটা ক্যান্সেল করে হলেও মামুনের ডাকে সাড়া দিই। অথচ তার সঙ্গে আমার প্রেমটা হলো না!
হওয়াটাই তো স্বাভাবিক ছিল। তোমার মনজুড়ে আছে মামুন। এমনকি রাশেদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পায় সে তোমার কাছে। তার পরও প্রেমটা হলো না কেন?
ওই যে বললাম, তার ভেতরে আমি ঐকান্তিক সমর্পণ দেখিনি। আমি তার একমাত্র ছিলাম না।
এই কথাটা তো তোমার ক্ষেত্রেও খাটে।
মানে?
রাশেদের প্রতি কি তোমার ঐকান্তিক সমর্পণ আছে? সে কি তোমার একমাত্র?
মনে তো হয়, আছে!
নিশ্চিত নও?
এ প্রসঙ্গটা থাক।
থাকবে?
ও, হ্যাঁ, আরেকটা কথা। রাশেদ বন্ধু হিসেবে অসামান্য, যেকোনো কিছু ওর সঙ্গে শেয়ার করা যায়। এ রকম বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
তাহলে সম্পর্কটিকে বন্ধুত্বের পর্যায়েই রাখলে না কেন? প্রেমের দিকে টেনে নেবার কি কোনো দরকার ছিল?
টেনে নিইনি তো, এমনিতেই ও-রকম হয়ে গেছে!
এমনিতেই কখনো হয়? এত বড় একটা ব্যাপার কোনো ভাবনাচিন্তা ছাড়াই হয়ে গেছে? তোমরা দুজন কি স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরী?
থাক, এ প্রসঙ্গে আর কিছু না বলি।
ঠিক আছে, মামুনের কথাই বল।
আর কী বলব? ও হ্যাঁ, প্রেম না হবার আরেকটি কারণ আছে।
কী সেটা?
লোকটা বড্ড বেশি শরীরকেন্দ্রিক। আমার শরীর নিয়ে সে এত কথা বলেছে…
মন আর শরীর কি আলাদা? প্রেম কি শুধু মনে হয়, শরীরে হয় না?
হয়। প্রেম হলে শরীর তো আসতেই পারে। মামুন আমার শরীর চাইত, প্রেম হলে আমি সেটা সানন্দে দিতাম, যতবার চাইত ততবার দিতাম। আমার নিজেরও তো মুগ্ধতা ছিল, আমিও চাইতাম ওকে। কিন্তু প্রেমহীন শরীরের কথা আমি ভাবতে পারি না।
কিন্তু তুমি তো তার ওই কথাগুলো পছন্দ করতে!
পছন্দ করতাম! কে বলল আপনাকে?
করতে না?
নাহ! খুবই বিব্রতকর ছিল ব্যাপারটা।
তাহলে এত কথা বলার পরও, সরাসরি তোমার শরীর চাওয়ার পরও, তুমি তার সঙ্গে সম্পর্কটি রেখেছ কেন?
সম্পর্ক হয়নি তো!
প্রেমের সম্পর্ক হয়নি। কিন্তু একটা সম্পর্ক তো আছে। সেটা তো বন্ধুত্ব!
কেবলই বন্ধুত্ব? আর কিছু নয়? তোমার অন্য কোনো বন্ধু যদি তোমার শরীর নিয়ে এত কথা বলত, যদি তোমার কাছে শরীর চাইত, তাহলেও ওই বন্ধুত্বটা টিকত?
রূপা এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকায় আমিও আর কোনো প্রশ্ন করি না। বুঝতে পারি—এই প্রশ্নের কোনো উত্তর রূপার কাছে নেই। এই সংকটের কোনো মীমাংসাও ওর কাছে নেই।
আট
কথাবার্তা ছেড়ে আবার গল্পে ফিরে আসি। অবশ্য গল্প প্রায় ফুরিয়েই এল। এই জটিল আবর্তের গল্প বলতে থাকলে একের পর এক জটিলতা তৈরি হতেই থাকবে।
রাশেদকে নিয়ে রূপা বেশ ভালোই বিপদে পড়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে নির্লিপ্ত মনে হলেও রূপার ব্যাপারে ভীষণ আবেগপ্রবণ সে, আর আচরণটিও ঠিক একজন কিশোরের মতো—সারাক্ষণ লেপ্টে থাকতে চায়! রূপার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা না হলে নিজেকে শূন্য মনে হয় রাশেদের, হাহাকার জেগে ওঠে মনের ভেতর, আর মনে হতে থাকে—এই পৃথিবীটাই বিরাট এক শূন্য! অভিমানে গাল ফুলায় সে, রূপাকে মুহুর্মুহু অভিমানী মেসেজ পাঠাতে থাকে, রূপা প্রথম দু-চারটে মেসেজের উত্তর দিলেও একটু পরেই এসব বালখিল্য কথাবার্তার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং চুপ মেরে যায়। ওদিকে রাশেদের অভিমান তুঙ্গে ওঠে, এমন সব কথা লিখে পাঠাতে থাকে, যা তার চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই যায় না, কিন্তু সেগুলো রূপার পাহাড়সম নীরবতায় এতটুকু চিড় ধরাতে পারে না, কারণ রূপার বিরক্তি ততক্ষণে বাড়তে বাড়তে চূড়ায় ওঠে, ইচ্ছে হয়, খুব কঠিন কিছু শুনিয়ে দিতে, সেটা করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায় কেবল। এক সময় রাশেদ ক্লান্ত হয়ে কেবল বলতে থাকে—‘একটু কথা বল, একটু…।’ রূপা সেই একই উত্তর দেয়—‘তুমি রেগে আছ, মাথা ঠান্ডা কর, তারপর বলব!’ রাশেদ রেগে নেই, বরং আকুল হয়ে আছে তার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য, কিন্তু এ কথা সে মেয়েটিকে কীভাবে বোঝাবে? সে দেখতে পায়, তার সঙ্গে কথা না বললেও ফেসবুকে মামুনের সঙ্গে তুমুল আড্ডায় মেতেছে রূপা, তার মন্তব্যগুলোতে ওই নক্ষত্র-পুরুষের প্রতি তার প্রেম উপচে পড়ছে। এর মানে কি এই নয় যে, তার এই অভিমান এই আকুলতা রূপাকে এতটুকু স্পর্শ করেনি? ঈর্ষার বদলে তার মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়—ঈর্ষা করবার যোগ্যতাও নেই তার, এবং রূপার মনে ও জীবনে তার জন্য কোনো স্থান নেই! নীরব হয়ে যায় সে, যতক্ষণ পারে নীরবই থাকে, আর তাদের সম্পর্কের ধরনটি বোঝার চেষ্টা করে। তার তরফ থেকে এটা প্রেম, প্রবল-আবেগাক্রান্ত-কৈশোরিক-উপচে পড়া প্রেম! কিন্তু রূপার তরফ থেকে? সে কি সত্যিই ভালোবেসেছে? নাকি রূপা-মামুন-নীলিমার ত্রিভুজ সম্পর্কের ভেতরে সে অনাহূতের মতো ঢুকে পড়েছে? যদি ওদের দুজনের ভেতরে নীলিমা ঢুকে ঝামেলা না বাঁধাত, তাহলে কি রূপা আদৌ তার দিকে ফিরে তাকাত? মনে হয় না! রূপা তো তার সকল নিয়েই বসে ছিল মামুনের জন্য। বিভিন্ন সময় ফেসবুকের পাতায় পাতায় সে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছে মামুনের প্রতি তার প্রেমের কথা, এমনকি কোনো কোনো মন্তব্য এমন আগ্রাসী ছিল যে, কেবল ‘ভালোবাসি’ শব্দটি উচ্চারিত হয়নি, বাকিটুকু এরচেয়ে বেশি কিছু বলেছে। মামুনের প্রতি নিজের ভালোলাগা প্রকাশের জন্য সে এতটাই আগ্রাসী যে, ভুলেই গেছে—এটা বাস্তব জগতের কোনো এক নির্জন গৃহকোণ নয় যে, কথাগুলো কেউ শুনছে না! বরং উল্টোটাই। ইন্টারনেট এমন এক যোগাযোগমাধ্যম যে, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো মানুষ এই মন্তব্যগুলো পড়তে পারে। তবে এত কিছুর পরও এসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে চাইত না রাশেদ। মানুষের জীবনে কত কী ঘটে—ইচ্ছেয়-অনিচ্ছেয়, কিংবা মুহূর্তের আবেগে! অতীতে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা টেনে এনে বর্তমানের সুন্দর-মায়াময় সম্পর্কটিকে কলুষিত করার মতো মানুষ সে নয়। অথচ সে তা-ই করে চলেছে। করত না, যদি সে দেখতে পেত, তার সঙ্গে সম্পর্কিত হবার পর মামুনের কাছ থেকে সরে এসেছে রূপা। সরে তো আসেইনি, বরং আকর্ষণ যেন আরও বেড়েছে। নইলে তার আপত্তি উপেক্ষা করে মামুনের সঙ্গে এ রকম সর্বক্ষণিকভাবে লেপ্টে থাকত না সে। প্রেমটা তার সঙ্গে, লেপ্টে থাকার কথাও তার সঙ্গেই, কিন্তু রূপা করে উল্টোটা। রাশেদ যে কষ্ট পেতে পারে, এ নিয়ে যেন কোনো ভাবনাই নেই মেয়েটির। এমনকি তার অনুভূতিরও কোনো মূল্য দেয় না রূপা। রাশেদের দিনগুলো বিমর্ষ হয়ে ওঠে, বিষণ্নতা বাড়ে, ঘরের এক কোণে নির্জনে বসে ভাবে—‘ভালো যদি না-ই বেসে থাক, তাহলে এসেছ কেন? আমি তো তোমাকে জোর করিনি!’ ভাবে, ওদের ভেতরে এভাবে ঢুকে পড়াটা খুব অন্যায় হয়েছে। সে না ঢুকে পড়লে রূপা-মামুনের প্রেমটা অনিবার্য আর সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র; আর প্রেমটি হলে কী সুখীই না হতো মেয়েটা! সে এসে রূপার জীবনটাকে যন্ত্রণায় ভরে দিয়েছে! বড় অপরাধবোধ হয় তার, নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয়, ইডিয়ট মনে হয়, মনে হয় এতকাল পরেও সে একটা ইতর প্রাণীর ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না! তীব্র বিমর্ষতায় ছেয়ে থাকে তার মন, কিন্তু কী যে করবে ভেবে পায় না। রূপাকে সুখী করে তোলার সাধ্য তার নেই। সে যদি চলে যেতে চায় মামুনের কাছে, যদিও রাশেদ নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে যাবে, তবু এতটুকু বাধা দেবে না—এইটুকু কেবল জানাতে পেরেছে। শুনে রূপা যথারীতি তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করেছে, ঝাঁজালো স্বরে বলেছে—
এই সব নিয়ে আমি তোমার কাছে কোনো কথা শুনতে চাই না। কতবার বলব যে, ওর সঙ্গে আমার প্রেম ছিল না!
আমি তো বলিনি, প্রেম ছিল!
তাহলে ওর কাছে যাওয়ার কথা উঠছে কেন?
যদি তোমার যেতে ইচ্ছে করে, সেই কথা বলতে চাইছিলাম।
খবরদার ওকে নিয়ে কোনো কথা বলবে না। ওর সম্বন্ধে কিছু বলার কোনো যোগ্যতাই তোমার নেই।
রাশেদ আর কথা বাড়ায়নি! যোগ্যতা যে নেই, সে সেটা খুব ভালো করেই জানে। এতটা কঠোরভাবে না বললেও পারত রূপা—এই কথা ভেবে আবার মন খারাপ হলো তার। জীবনটাই যেন কেমন অদ্ভুতুড়ে তার; যে জীবনে প্রেম আসেনি কখনো, কেউ নিজে থেকে ভালোলাগার কথা জানায়নি; আর যাদের প্রেমে সে নিজে পড়েছে, সেটা জানাতেও দ্বিধান্বিত থেকেছে, কী এক কুণ্ঠা এসে বাধা দিয়েছে, দু-এক জনকে জানালেও সাড়া মেলেনি! সেই অর্থে রূপাই তার প্রথম প্রেম, অথচ কী বেদনায় ভরা! সাড়া সে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এ যে কেমন সাড়া বুঝে উঠতে পারে না রাশেদ! রূপা যে কেন তার প্রতিটি কথায় এত বিরক্ত হয়, সে বুঝতেই পারে না। এমনকি প্রেমময় কথাগুলোতেও সে তেতে ওঠে। দেখা করতে চাইলে, কথা বলতে চাইলে, ইমেইলের উত্তর চাইলে সে এমনভাবে ক্ষেপে ওঠে যে, এর কারণটি কোনোভাবেই আবিষ্কার করতে পারে না রাশেদ। এসব কথাকে নাকি রূপার কাছে অভিযোগ মনে হয়, বলে—‘আমি অভিযোগ নিতে পারি না, তাই তোমার সঙ্গে কথা বাড়াই না!’ অভিযোগ! দেখা করতে চাওয়া এবং না পেরে অভিমান প্রকাশ করাটা অভিযোগ? কথা বলতে চেয়ে এবং সাড়া না পেয়ে মন খারাপ হওয়ার কথা জানানোটা অভিযোগ? তাহলে প্রেম কোনটা? নাকি তার বলার ধরনেই সমস্যা? রূপা সব সময় বলে—‘মামুন এত মিষ্টি করে কথা বলে যে কী বলব! আমি অনেক সময় তার সাথে রাগারাগি করেছি, কিন্তু সে কখনো এতটুকু খারাপ ব্যবহার করেনি। সব সময় মিষ্টি হেসে মিষ্টি করে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছে।’ রাশেদ তো মিষ্টি করে কথা বলার কৌশল শেখেনি। কিংবা তার স্বরটিই হয়তো কর্কশ। কীভাবে বললে যে তার প্রেমগুলো প্রেম হিসেবেই পৌঁছাবে রূপার কাছে, অভিযোগ হিসেবে নয়; তা-ও বোঝে না! তার কেবল মন খারাপ হয়, একা একা নিজের অস্তিত্বের অসারতা নিয়ে পোড়ে, পুড়ে চলে। তবে যতই মন খারাপ হোক, যতই পুড়ে ছাই হোক একা একা, দু-চার দিন, এমনকি কখনো কখনো সপ্তাহখানেক নীরবতার পর হঠাত্ একদিন রূপা ফোন করে বসলে রাশেদের সব অভিমান, রাগ, কষ্ট ধুয়েমুছে যায়। এত ভালোবাসে সে ওই কণ্ঠস্বর যে, এত দিন ধরে সে যে কাতর প্রার্থনা জানিয়েও রূপাকে কথা বলার জন্য রাজি করাতে পারেনি—সেকথাও ভুলে যায়। রূপাও বুদ্ধিমতী মেয়ে। এমনভাবে কথা বলে যেন, এ ক-দিনে কিছুই ঘটেনি, কিছুই হয়নি। যেন এক সপ্তাহ পরে নয়, এক ঘণ্টা পরেই আবার কথা হচ্ছে তাদের।
এভাবেই চলছিল এই অদ্ভুত প্রেম। কিন্তু রূপার ভেতরে যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে, সেটা ততটা খেয়াল করে উঠতে পারেনি রাশেদ। মান-অভিমানের সময়টুকু ছাড়া তাদের যে প্রেমময় সময়টুকু কাটত, তখনো খুব বেশি দেখা হতো না বটে, কিন্তু ফোনে কথা বলার সময় রাশেদ নানা প্রসঙ্গ তুলত। এবং কথা প্রসঙ্গেই ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিত—রূপা নিজের প্রতি অন্যায় করছে। স্রেফ আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো রূপাকে মানায় না, আরও অনেক কাজ করার আছে তার। তার লেখার হাত চমত্কার, সে লেখালেখি করতে পারে; গানের গলা ভালো, গাইতে পারে; সময় কাটাবার জন্য ফেসবুক-চ্যাটরুমের চেয়ে বই পড়া অনেক ভালো, আর রূপার সেই অভ্যাসটিও পুরোদমেই ছিল, আড্ডাবাজির তোড়ে ভেসে গেছে প্রায়, ইচ্ছে করলেই অভ্যাসটি ফিরিয়ে আনতে পারে। রূপাও কনভিন্সড হয়, মনে হয়—শুধু খোকার প্রতি নয়, নিজের প্রতিও সে অবিচারই করেছে। এটা কোনো জীবন হলো? এই অবিরাম, অনির্দিষ্ট, ফলাফলহীন আড্ডার জীবন! ধীরে ধীরে সে ফিরতে থাকে নিজের জগতে। প্রতিদিন না গিয়ে দু-এক দিন বিরতি দিয়ে আড্ডায় যেতে শুরু করল, তারপর সেই বিরতি বেড়ে এক সপ্তাহ, তারপর একমাসে দাঁড়াল। খোকাকে সময় দিতে লাগল, আলমিরা ভরতি না-পড়া বইগুলো তুলে নিল হাতে, ডুবে গেল একেকটা বইয়ের ভেতরে, সময় কেটে গেল তরতর করে। কম্পিউটারে বসে চ্যাট-ফেসবুক খুলেও সেগুলোতে চোখ না রেখে একটু-আধটু করে লিখতে লাগল, আর মাঝে মাঝে সেগুলো পোস্ট করতে লাগল ফেসবুকের নোট হিসেবে। সব লেখারই দারুণ ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রেসিয়েশন পেল রাশেদের কাছ থেকে। রাশেদ, যতই আটপৌরে হোক না কেন, বিনা কারণে কাউকে অ্যাপ্রেশিয়েট করে না, শক্তিমান শিল্পী হিসেবে তার কথাকে গুরুত্ব দেয় সবাই। দেয় রূপাও—সম্পর্কের কথা না ভেবেও। তার ভালো লাগতে থাকে। যতই সে নিজের জগতে ফিরতে থাকে, ততই তার মনের ভেতরে একটা পরিবর্তন সে টের পায়! সময়ের কী দারুণ অপচয়ই না করেছে সে! ও-রকম সারবস্তুহীন আড্ডার কোনো মানে হয়? আর ওই আড্ডার জন্য সে খোকার জন্যও সময় দিতে পারেনি, অন্য সব বিষয় তো দূরে থাকুক। অবশ্য আড্ডাবাজি পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া এত সহজ হয়ে ওঠে না তার জন্য। বন্ধুরা নিয়মিতই তাকে ডাকে, সে নানা কৌশলে এড়িয়ে যায় বটে, কিন্তু সব সময় সেটা পেরে ওঠে না। বিশেষ করে মামুন ডাকলে এখনো তার মনটা এলোমেলো হয়ে যায়। সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। কঠিন শাসনে নিজেকে সামলায় সে। বলা যায়, আগলে রাখে নিজেকে। এ ছাড়া উপায় নেই। ডাকে সাড়া দিলে যে আবারও ওই ফাঁদে গিয়ে পড়বে!
এভাবে চলতে চলতেই বন্ধুদের ডাকাডাকির পরিমাণ কমে আসে। সত্যি বলতে কি, আড্ডাগুলোই কমে আসতে থাকে। ওই ব্যাপারগুলো প্রধানত রূপাকেন্দ্রিকই ছিল। রূপা আসে না বলে মামুনও আসে না, আসে না আরও কেউ কেউ। ভাঙন ধরে আড্ডায়, ধুলো জমে সম্পর্কেও। মামুন ভেবেই পায় না, কী এমন হলো রূপার যে, এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিল! কোনো কষ্ট কি পেয়েছে কারও কাছ থেকে? কিংবা সে নিজে কি কখনো নিজের অজান্তে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মেয়েটিকে? সেটা যদি হয়েও থাকে, নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে সে। কিন্তু রূপা যে কিছু বলে না—সে বুঝবে কীভাবে, সে-ই এ জন্য দায়ী কি না! সে কখনো রূপার নীরবতার জন্য খারাপ ব্যবহার করে না, বরং মিষ্টি করে কথা বলে। সে জানে, মিষ্টি-মধুর কথা বলেই মেয়েটিকে নিজের কাছে ধরে রাখা যাবে! এসব কৌশল তার ভালো করেই জানা আছে। কিন্তু কী-ই বা কারণ থাকতে পারে এই নীরবতার? অন্য মেয়েদের প্রতি তার আকর্ষণের ব্যাপারটা রূপা মেনে নিতে পারত না, আর সে আকর্ষণ বোধ করার কথা গোপন করত না, ভণ্ডামি তার পছন্দ নয় বলে—রূপা কেন বুঝতে পারল না ব্যাপারটা? আর তা ছাড়া, সে কি নিজেকে অন্য সবার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়নি? নীলিমার সঙ্গে কি সম্পর্ক নষ্ট করেনি? অন্য মেয়েদের সঙ্গে তার মেলামেশাও কি কমিয়ে আনেনি? সে যখন নিজেকে রূপার মনমতো করে গড়ে তুলবার চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন তার এই নীরবতার অর্থ কী? সে কি তবে প্রেমে পড়েছে অন্য কারও? সেটাও কি সম্ভব? রূপা কি তার চেয়েও আকর্ষণীয় কোনো পুরুষের দেখা পাবে কোনো দিন? যে ঘোরলাগা প্রেম সে দেখেছে মেয়েটির চোখে, তা কি মুছে ফেলতে পারবে এত সহজে? কেবল প্রশ্নের-পর-প্রশ্ন আসে মনে, উত্তর মেলে না! এত প্রশ্ন সত্ত্বেও সে রূপাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারে না। যোগাযোগের চেষ্টা অব্যাহত থাকে, আর মনে মনে ভাবে—একদিন সে গিয়ে দাঁড়াবে রূপার সামনে; বলবে—‘আমি তোমাকে নিতে এসেছি। তুমি বলেছিলে, আমি যেদিন নিয়ে যাব, সেদিন আমার সঙ্গে যাবে। আমরা মিলিত হব একান্তে, নির্জনে। আজকে এসেছি চল।’ সে জানে, একবার গিয়ে রূপার হাত ধরলে সে ফেরাতে পারবে না, তাকে ফেরাবার ক্ষমতা মেয়েটির নেই। এসব ভেবে একটু শান্ত হয় সে। বাড়াবাড়ি তার চরিত্রের মধ্যে নেই। রূপা হয়তো কোনো ট্র্যানজিশন পিরিয়ডের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া সেরে নিচ্ছে; নিক। একদিন গিয়ে সব দেয়াল ভেদ করে সে ঠিকই রূপাকে ছিনিয়ে নিয়ে আসবে!
দিন যায়। আর রূপার দিনগুলো আবার একঘেঁয়ে হয়ে উঠতে থাকে! সেই একই রুটিন, একই কাজ, একই মানুষ! মাঝে মাঝে সেই আড্ডামুখর দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে তার। কী নির্ভার, নির্মল দিন ছিল সেসব! প্রায় ক্ষীয়মান হয়ে আসা যোগাযোগ, তবু মামুনের জন্য মন কাঁদে কখনো কখনো! আহা, কী অসামান্য এক আকর্ষণীয় পুরুষ! প্রেমটা হলো না, হলে জীবনটা নিশ্চিতভাবেই আনন্দমুখরতায় ভরে থাকত! যত দিন যায়, রাশেদ তত পুরোনো হতে থাকে তার কাছে, তত বিরক্তিকর, তত অনাকর্ষণীয়, তত সাধারণ ও সহজলভ্য। মনে হয়, এ রকম প্রেম পথে পড়ে থাকাই ভালো, কুড়িয়ে নেবারও প্রয়োজন ছিল না! না চাইতেই যাকে পাওয়া যায়, আর যার কাছে পাওয়া যায় প্রশ্নহীন আনুগত্য ও সমর্পণ, তার প্রতি তো এমন অনুভূতিই তৈরি হওয়ার কথা! আর অচরিতার্থ প্রেমের প্রতি থাকে আমৃত্যু আকর্ষণ। মামুন রূপার সেই অচরিতার্থ প্রেম, রূপা যেমন মামুনের কাছে। দুজন মানুষ অচরিতার্থ প্রেমের যন্ত্রণা নিয়ে পরস্পরের জন্য অপেক্ষা করে।
এসব নানা ভাবনায় কখনো কখনো তীব্র বিষাদে মন ছেয়ে থাকে রূপার। মনে হয়—এই জীবন সে চায়নি!
পেছনের দিকে ফিরে তাকিয়ে কত কথা মনে পড়ে! কত ভালোলাগা, কত প্রেম, কত অপারগতা, কত বিচ্ছেদ! সেই সুদূর কৈশোরেই প্রেমের দেখা পেয়েছিল সে, তুমুল-কূলপ্লাবী-বিপুল আবেগে ভেসে যাওয়া প্রেম। সেই প্রেম নিয়ে থাকতে থাকতেই এসেছে আরও অনেক প্রেম, অনেক ভালোলাগা, যার অনেকগুলোই বেশ আগ্রাসী ছিল। একজন তো যেকোনো মূল্যে তাকে পেতে চেয়েছিল। সম্পদশালী ছিল সে, আর ভেবেছিল, সম্পদের লোভ দেখিয়ে রূপাকে মুগ্ধ করা যাবে। তার প্রেমে ও চাওয়ায় কোনো খাদ হয়তো ছিল না, হয়তো প্রেম দিয়ে পাওয়া যায়নি বলে প্রাচুর্যকে কাজে লাগাতে চেয়েছে, কিন্তু বুঝতে পারেনি—ওসব দিয়ে রূপাকে পাওয়া যাবে না। বিয়ের পরও সে তার পিছু ছাড়েনি, এমনকি এখনো, এই এত দিন পরও, সে মাঝে মাঝে উদয় হয়, রূপাকে পেতে চায়, কিন্তু রূপা আগের মতোই নির্বিকার থাকে। এ রকম প্রেম বিয়ের পরও এসেছে একাধিক। যেমন, এক সহকর্মী, নিতান্তই নিরীহ-নির্লিপ্ত এক মানুষ, রূপাকে পছন্দ করার ব্যাপারটা বুঝতেই দিতে চাইত না, যদিও সে সবই বুঝত, এক জন্মদিনে একশ-টা গোলাপ আর প্রিয় একটি কবিতা তাকে উপহার দিয়েছিল। রূপা বুঝে নিয়েছিল, এ-ই তার প্রেমের প্রকাশ, তার মন দুলে উঠেছিল, উপহারটি গ্রহণ করেছিল হাসিমুখেই, কিন্তু প্রেমটি গ্রহণ করেনি। এ রকম কত প্রেম যে তার জীবনে এসেছে, হিসেব নেই, সে গ্রহণের অপারগতার যন্ত্রণায় ভুগেছে কেবল। অথচ সে-ই কিনা যাকে চাইল সর্বান্তকরণে, তার সঙ্গে প্রেমটি হয়ে উঠল না! হলো এক সাদামাটা-আটপৌরে-ইডিয়ট লোকের সঙ্গে! নিজেকে সে ক্ষমা করতে পারে না। মনে হয়, এমন দুর্ভাগ্য যেন কোনো শত্রুরও না হয়!
তবে এত কিছুর পরও কোনো এক অদ্ভুত কারণে রূপা-রাশেদের সম্পর্কটি বহমান থাকে নানা প্রশ্ন নানা সংকটেও, আনন্দ-বেদনায়, সুখে-দুঃখে, গ্লানি ও বিরক্তিতে, মমতা ও ভালোবাসায়।
একদিন, হয়তো দিনটা মেঘলা ছিল, হয়তো রূপার মনটা গুমোট হয়ে ছিল, আর তার মধ্যেই চলছিল তাদের কথোপকথন, এসএমএস বিনিময়, হয়তো ভালো লাগছিল না বলে ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল সেই পড়ন্ত বিকেলে, আর রাশেদকে লিখেছিল—
ছাদে এলাম। মাথার ওপর বিশাল আকাশ, একা!
উত্তর আসে—আমার মতো!
প্রতি-উত্তরে রূপা লেখে—আমার মতো!
তোমার তো আমি আছি!—বোকার মতো বলা হলো জেনেও কথাটা বলার লোভ সামলাতে পারে না রাশেদ। হয়তো তার মন চাইছিল, রূপাও তাকে এই কথাটা বলুক। কিন্তু রূপা লিখল অন্য কথা—
মানুষ মূলত একা।
তা ঠিক।
এই একাকিত্বকে স্পর্শ করার মতো ক্ষমতা বিধাতা কাউকে দেননি!
রাশেদ আর কোনো উত্তর দেয় না! বুঝে নেয়, সে নিজে যে একাকিত্বের যন্ত্রণায় কাতরেছে জীবনভর, রূপারও সেই একই যন্ত্রণা। এবং রাশেদের এই তীব্র প্রেম তার সেই একাকিত্বকে এতটুকু ভরিয়ে দিতে পারেনি সঙ্গ ও ভালোবাসায়! রূপার নিঃসঙ্গতাকে স্পর্শ করবার সাধ্য তার নেই, আসলেই!



Popular Posts